যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মের ব্রেক্সিট চুক্তিটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হলো না কেন? কেন তাঁর নিজের রক্ষণশীল দলেরই ১১৮ জন এমপি এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। বিশাল ব্যবধানে, ৪৩২-২০২ ভোটে—প্রস্তাবটি পরাজিত হয়েছে, যা বিস্মিত করেছে সবাইকে। কেন এমন হলো? এর পেছনে কাজ করেছে বহু রকমের কারণ, যা বেশ জটিল।

প্রথম কথা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোর মধ্যে কোন সীমান্ত চৌকি, দেয়াল বা বেড়া—এসব কিছুই নেই। এক দেশের লোক অবাধে যখন-যেভাবে খুশি আরেক দেশে যেতে পারে, অন্য দেশে গিয়ে কাজ করতে পারে। কিন্তু ব্রিটেন যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে তো ব্রিটেন অন্য দেশ হয়ে গেল। ফ্রি মুভমেন্ট অব পিপল, যা ইইউর মূল নীতির অন্যতম স্তম্ভ—তা আর তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না এবং সে ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ইইউর মধ্যে সীমান্ত ফাঁড়ি থাকতে হবে। এক দেশের লোক বা পণ্য আরেক দেশে যেতে হলে কাস্টমস চেকিং পার হতে হবে। কিন্তু ব্রিটেন হলো একটা দ্বীপপুঞ্জ। সাধারণভাবে ইউরোপ ও ব্রিটেনের মধ্যে স্থল সীমান্ত নেই। এই দুয়ের মাঝখানে আছে সমুদ্র, ইংলিশ চ্যানেল এবং নর্থ সি। এই সাগরই সীমান্ত।

শুধু একটি-দুটি ক্ষেত্র ছাড়া। যেমন আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড মিলে একটি আলাদা দ্বীপ।

উত্তর আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের অংশ, আর আইরিশ প্রজাতন্ত্র একটি পৃথক দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। এই দুয়ের মধ্যে আছে স্থল সীমান্ত। তাই ব্রেক্সিটের পর এটিই পরিণত হবে ইউরোপ আর ব্রিটেনের স্থল সীমান্তে। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেলেই এ সীমান্তে কাস্টমস চৌকি বসাতে হবে।

আয়ারল্যান্ড আর উত্তর আয়ারল্যান্ডের মধ্যে যত মানুষ ও পণ্য এখন মুক্তভাবে চলাচল করে, তখন তা আর থাকবে না। শত শত ট্রাক-বাসকে এখানে থামতে হবে, কাস্টমস চেকিংয়ে জন্য লাইন দিতে হবে, পণ্য চলাচলে অনেক সময় ব্যয় হবে, দিতে হবে শুল্ক।

তা ছাড়া এই দুই আয়ারল্যান্ডের মানুষের ভাষা এক, সংস্কৃতি এক, অনেক পরিবারেরই দুই শাখা দুই দিকে বাস করে। ইইউর অংশ হওয়ার কারণে এত দিন সেখানকার লোকেরা মুক্তভাবে একে অন্যের দেশে গিয়ে চাকরিবাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য করত। এ সব কিছুর মধ্যেই তখন নানা বাধার দেয়াল উঠে যাবে।

আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সহিংস বিদ্রোহের অবসানের জন্য হওয়া গুড ফ্রাইডে চুক্তিতেও আয়ারল্যান্ডের দুই অংশের যোগাযোগ যেভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে, তাও এতে বিপন্ন হতে পারে।

এটা যাতে না হয় সে জন্যই ব্রেক্সিটের পরের জন্য টেরেসা মের পরিকল্পনায় ছিল ‘ব্যাকস্টপ’ নামে এক ব্যবস্থা। এতে বলা হয়, দুই আয়ারল্যান্ডের মধ্যে কোনো ‘হার্ড বর্ডার’ বা বাস্তব সীমান্ত থাকবে না, মানুষ ও পণ্যের অবাধ চলাচল যথাসম্ভব আগের মতোই থাকবে। তবে ব্যাকস্টপ ব্যবস্থায় সেই সীমান্ত পিছিয়ে চলে যাবে আইরিশ সাগরে।

অর্থাৎ উত্তর আয়ারল্যান্ড থেকে পণ্যবাহী ট্রাক যখন ব্রিটেনের মূল ভূমিতে ঢোকার পথে সাগর পার হবে, তখন তার কাস্টমস চেকিং হবে, তার আগে নয়।

অন্যদিকে ব্রিটেন থেকে যখন পণ্যবাহী ট্রাক উত্তর আয়ারল্যান্ডে যাবে, তখন সেই পণ্য ইইউ মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, তাও পরীক্ষা করাতে হবে।

কিন্তু এর বিরোধীদের আপত্তি হলো, তাহলে তো দেশের দুই অংশের জন্য দুই নিয়ম হয়ে যাচ্ছে। ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলেও তার অংশ উত্তর আয়ারল্যান্ড ইইউর আইনের কাঠামোর মধ্যেই থেকে যাচ্ছে, এটা হতে পারে না।

টেরেসা মে বলছেন, এ ব্যবস্থা হবে সাময়িক। কিন্তু তাঁর পরিকল্পনার বিরোধীরা বলছেন, এই চুক্তিতে ব্যাকস্টপের কোনো সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি এবং যুক্তরাজ্য চাইলেও একতরফাভাবে এ থেকে বেরিয়েও যেতে পারবে না।

টেরেসা মের চুক্তির বিরোধীরা বলছেন, এর ফলে ব্রিটেন আসলে কখনোই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরোতে পারবে না, ইইউর সম্মতি ছাড়া ব্রিটেন কোনো সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন করতে পারবে না, এর ওপর ইইউকে ব্রিটেন যে চাঁদা দেয়, তাও দিতে হবে।

কিন্তু টেরেসা মে বলছেন, তাঁর চুক্তিই একমাত্র দলিল, যার ফলে ইইউ থেকে ব্রিটেনে অবাধে ইউরোপীয়দের আগমন ও চাকরি করা বন্ধ হবে, ইউরোপীয় আদালতের প্রাধান্য থেকে মুক্ত হয়ে ব্রিটেন তার ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করতে পারবে, পৃথিবীর যেকোনো দেশের সঙ্গে স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের চুক্তি করতে পারবে এবং তার সমুদ্রসীমার কর্তৃত্ব ফিরে পাবে, ব্রিটেনের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হবে। কিন্তু তাঁর এই প্রস্তাব পার্লামেন্টে পাস হয়নি, ২৩০ ভোটের ব্যবধানে তা পরাজিত হয়েছে।

ব্রিটেনের ইতিহাসে এত বড় ব্যবধানে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর কোনো প্রস্তাব পার্লামেন্টে হেরে যায়নি। ফলে অনেকেই বলছেন, টেরেসা মের ব্রেক্সিট চুক্তি, যাতে ইইউর নেতাদেরও সম্মতি ছিল, তা এখন মৃত। টেরেসা মেকে পদত্যাগ করতে না হলেও তিনি ওই প্রস্তাব নিয়ে আর এগোতে পারবেন না। তাঁকে ব্রেক্সিটের নতুন কোনো পরিকল্পনা নিয়ে আসতে হবে।

২৯ মার্চের আগে তা না পারলে কোনো চুক্তি ছাড়াই ব্রিটেনকে ইইউ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, যা তাঁর অর্থনীতি-রাজনীতির জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে অনেক বিশ্লেষকই বলছেন। সূত্র : বিবিসি।

মন্তব্য