ধর্ষণের পর খুন’ দিশা মনির ৪৯ দিন পর ফিরে আসায় নারায়ণগঞ্জে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সারাদেশের এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচান-বিতর্ক। সর্বত্রই আলোচনা আসামীরা ‘হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দেয়ার পর নিহত ব্যাক্তি কী করে ফিরে এলো? আসামীর পরিবারের সদস্যরা অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন আইন শৃংখলা বাহিনীর দিকে। তারা দেশি-বিদেশী মিডিয়ার সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন তদন্তকারী পুলিশ নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি দিতেবাধ্য করেছে। পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা দফায় দফায় টাকা নিয়েছেন। দিশার বাবাও বলেছেন, পুলিশ তার মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের অনেকেই দিশার ফিরে আসার ঘটনাকে ‘জজমিয়া’ নাটকের সঙ্গে তুলনা করছেন। জীবিত থাকার পরও নারায়ণগঞ্জের দিশাকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগের দায়ের করা মামলায় আসামিদের স্বীকারোক্তি আদায় সংক্রান্ত সদর থানার ওই মামলার কার্যক্রমের বৈধতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাইকোর্টে আবেদন (রিভিশন) করা হয়েছে। সেই আবেদনের ওপর আজ বৃহস্পতিবার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জে দিশা মনিকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেয়া হয়েছে। এ হত্যার ঘটনায় তিন আসামী নারায়ণগঞ্জ আদালতে এমনিই জবানবন্দি দেন। অথচ জবানবন্দিতে সেই খুন হওয়া দিশা ৪৯ দিন পর গত রোববার জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছে। গত সোমবার দিশা মনি ফিরে আসার বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত করেছে। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। সর্বত্র শুরু হয়েছে বিতর্ক। দিশা মনি নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ পাক্কা রোড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। গত ৪ জুলাই সে নিখোঁজ হয়। ঘটনার একমাস পর ৬ আগস্ট থানায় অপহরণ মামলা করেন তার বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন। মামলায় আসামী রকিব (১৯), আব্দুল্লাহ (২২) ও নৌকার মাঝি খলিলকে (৩৬) গ্রেফতার করা হয়। তিন আসামি গ্রেফতারের পর ৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিল্টন হোসেন ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ুন কবিরের পৃথক আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। স্বীকারোক্তিতে তারা জানায়, ‘পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী দিশা মনিকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়’। জবানবন্দি দেয়া ওই তিন আসামী বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে রয়েছে। এখন দিশা ফিরে আসায় ‘জবানবন্দি’ নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। মামলা দায়ের পর এ ঘটনায় পুলিশের তদন্ত নিয়েও নানামুখী প্রশ্ন উঠেছে। আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়া সেই তিন আসামী নিরাপরাধ, না দোষী এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, আইন শৃংখলা বাহিন যে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করে থাকেন দিশার ঘটনা উদাহরণ।

ধর্ষণের পর সেই খুন হওয়া দিশা ২৩ আগস্ট বন্দরের নবীগঞ্জ এলাকার একটি মোবাইল ফোনের দোকান থেকে তার মা-বাবা ফোন করে। বাবা-মা দিশাকে উদ্ধার করে সদর থানায় নিয়ে গেলে সৃষ্টি হয় রহস্য। দিশা মনির মা জানান, বন্দরের কুশিয়ারা এলাকায় ইকবাল নামে এক ছেলের সাথে গত দেড় মাস দিশা ছিল। ইকবাল ওরফে ইব্রাহিমকে সে বিয়ে করেছে। দিশা ফিরে আসায় তার মা-বাবাসহ আত্মীয়-স্বজনরা খুশি। কিন্তু গ্রেফতারকৃত তিন আসামীর স্বজনদের দাবি, পুলিশি নির্যাতনের মুখে তাদের দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা বলছেন, যেহেতু দিশা হত্যা হয়নি। কিংবা তাকে নির্যাতনও করা হয়নি। সে অন্য এক ছেলের সাথে পালিয়ে যায়। অথচ তাকে অপহরণের দায়ে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে পুলিশি নির্যাতনের মুখে তাদের দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়।
আব্দুল্লাহকে নির্দোষ দাবি করেম তার আমজাদ হোসেন বলেন, ‘এটা সাজানো নাটক। লাশ ভাসাইয়া দিলে তো ওই মাইয়ার লাশ ভাইস্যা উঠত। পুলিশ লাশ না উদ্ধার কইরাই ওরে বিনা অপরাধে শাস্তি দিছে। পুলিশ প্রচন্ড টর্চার কইরা ওরে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করছে। পুলিশ কইছিল ওরে মারধর করব না। এ জন্য গলাচিপা এলাকার পুলিশের সোর্স কিসলুর মাধ্যমে শামীম দারোগা দুইবারে ১০ হাজার টাকা নিছে। তার পরও পুলিশ ওরে ফাঁসাইয়া দিল?’ নারায়ণগঞ্জের ইস্পাহানি ঘাটে নৌকার মাঝি আসামী খলিলের ছোট ভাই আল আমিন বলেন, ‘গ্রেফতারের পর পুলিশের আন্দাগুন্দি মাইরের চোটে আব্দুল্লাহ ও রকিব ভাইয়ের নাম দিছে। পরে থানায় মাইরের ঠেলায় শিখাইয়া দেয়া কথা কইচে। ভাইরে মারব না, ছাইড়া দিব কইয়া পুলিশ আমার ভাবি শারমিন আক্তারের কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা নিছে।’ অটোরিকশাচালক রকিবের বড় ভাই মো. সজিব হোসেন বলেন, ‘পুলিশ রকিবকে দুই দফা রিমান্ডে নিয়ে মারধর কইরা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করছে। রিমান্ডে মারব না কইয়া দুই দফায় ১০ হাজার টাকা নেয়। পরে ছাইড়া দিব কইয়া আরো ২০ হাজার টাকা নেয়। কিন্তু ছাড়ে তো নাই-ই বরঞ্চ ফাঁসাইয়া দিছে।’ দিশা মনির বাবা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পুলিশ বলেছিল আমার মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় নির্দোষ তিনজনকে আটক করেছে পুলিশ। এই দেড় মাসে আমার মেয়েকে উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

তবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শামীম আল মামুনের দাবি, মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে ওই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে পরিবারের এমন অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আদালতে ওই তিনজন বুঝেশুনেই স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তাদের কোনো নির্যাতন করা হয়নি, কোনো টাকা-পয়সাও আদায় করা হয়নি।

‘দিশা ধর্ষণ ও খুন’ চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রকৃত চিত্র উদঘাটনের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলমের নির্দেশে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) জাহেদ পারভেজ চৌধুরীকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সহকারী পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মোঃ শালেহ উদ্দিন আহমেদ ও বিশেষ শাখার পরির্দক (ডিআই-ওয়ান) একেএমএস ইকবাল। পুলিশ সুপার মো. জায়েদুল আলম বলেছেন, দিশা মনির অন্তর্ধান, ফিরে আসা এবং তিন আসামির দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিসহ প্রকৃত চিত্র এই তদন্ত কমিটি খুঁজে বের করবে।

হাইকোর্টে শুনানী : জীবিত দিশাকে ‘মৃত’ হিসেবে জবানবন্দী প্রদানের নথি তলবের বিষয়ে আজ হাইকোর্টে বিচারপতি এম.ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ডিভিশন বেঞ্চে শুনানি হবে। খুন হওয়া দিশা ফিরে আসায় নারায়ণগঞ্জে তোলপাড় শুরু হলে দিশা জীবিত থাকার পরও আসামিদের স্বীকারোক্তি আদায় সংক্রান্ত নারায়ণগঞ্জ সদর থানার কার্যক্রমের বৈধতা ও যৌক্তিকতার প্রশ্ন তুলে হাইকোর্টে আবেদন (রিভিশন) করেন সুপ্রিম কোর্ট বারের অ্যাডভোকেট শিশির মনির। গতকাল অ্যাডভোকেট শিশির মনির জানান, নারায়ণগঞ্জ দেওভোগ এলাকার পাক্কা রাস্তা এলাকা থেকে ‘নিখোঁজ’ হয় স্কুল ছাত্রী দিশা। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলে ৩ আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রিমান্ডের পর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় তিন আসামি। তারা স্বীকার করে দিশাকে অপহরণের পর ধর্ষণ ও হত্যা করে। হত্যার পর তার লাশ শীতলক্ষ্যা ভাসিয়ে দেয়। তবে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদানের ৪৯ দিন পর জীবিত ফিরে আসে দিশা। আবেদনে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় করা মামলা এবং মামলা পরবর্তী প্রক্রিয়ার শুদ্ধতা, বৈধতা এবং যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়। আবেদনটি আদালত গ্রহণ করে শুনানির তারিখ ধার্য করেন।উৎস -ইনকিলাব