বামনায় সিফাত-শিপ্রার মুক্তি চেয়ে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে সদলবলে চড়াও হয়ে তা পণ্ড করে দিয়েছেন বরগুনার বামনা থানার ওসি ইলিয়াস আলী তালুকদার। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীদের লাঠিপেটার নির্দেশ তাৎক্ষণিক অতি উৎসাহে পালন না করায় থানার এক এসআইকেও চড়-থাপ্পড় মারেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই পুলিশ কর্মকর্তা। একপর্যায়ে নিজেই লাঠি হাতে বেপরোয়াভাবে পিটুনি শুরু করেন। একই সঙ্গে চলে তাঁর খিস্তিখেউড়।

কক্সবাজারের টেকনাফে গত ৩১ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ওই হত্যাকাণ্ডের পর সিনহা রাশেদের গাড়িতে থাকা তাঁর তথ্যচিত্র নির্মাণের সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাত এবং পরে শিপ্রা রানী দেবনাথকে আটক করে পুলিশ। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির এই দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পরে মামলাও দেওয়া হয়। সিফাতের মুক্তি দাবিতে তাঁর নিজ জেলা বরগুনার বামনা উপজেলায় গতকাল শনিবার মানববন্ধনের আয়োজন করে সহপাঠীরা। আর সেই কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে ওসি ইলিয়াস আলী এমন তাণ্ডব চালান।

সিনহা রাশেদ হত্যার বিচার এবং সিফাত ও শিপ্রার মুক্তি দাবিতে একই দিনে রাজধানীর স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে প্রতিবাদসভা হয়েছে। একই দাবিতে মানববন্ধন পালিত হয়েছে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে।

বরগুনার বামনা উপজেলার কলেজ রোডে গতকাল দুপুর ১২টায় প্রায় ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন অংশ নেয়। একপর্যায়ে সেখানে সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে হাজির হন ওসি ইলিয়াস। পুলিশ প্রথমেই মানববন্ধনের ব্যানার ও মাইক ছিনিয়ে নেয়। এর পরও সিফাতের বন্ধুরা মানববন্ধন চালিয়ে গেলে ওসি ইলিয়াস দৌড়ে এসে নিজেই অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা শুরু করেন। তাঁর লাঠির আঘাতে রুবেল, ইমরান, রায়হান ও মিথুন নামের চার শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। ওসি এর আগে থানার এক সহকর্মী এসআইকে চড়-থাপ্পড় মারেন লাঠিপেটায় আগ্রাসী না হওয়ায়। একই সঙ্গে গালি দিয়ে বলেন, ‘কী করেন আপনারা? পিটান সবাইকে।’ পরে তিনি কক্সবাজারের টেকনাফ থানার প্রতাপশালী ওসি প্রদীপের ভূমিকায় নেমে পড়েন। নিজেই লাঠি হাতে মানববন্ধনকারীদের বেপরোয়া পেটাতে শুরু করেন।

পুলিশের লাঠিপেটায় আহত এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা আমাদের বন্ধুর মুক্তির জন্য শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিলাম। এর আগেও মানববন্ধন করতে চাইলে পুলিশ বাধা দিয়েছে। বামনাজুড়ে টহল বসিয়ে আমাদের ভয়ভীতি দেখিয়েছে। বামনার ওসি ইলিয়াস আজকের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে টেকনাফের ওসি প্রদীপের চেয়েও ভয়ংকর রূপ নিয়ে লাঠিচার্জ করেছেন।’

প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তি বলেন, ‘পুলিশের একজন কর্মকর্তা যে এভাবে জঘন্য ভাষায় গালাগাল এবং অহেতুক লাঠিপেটা করতে পারেন তা আমরা জীবনে প্রথম দেখলাম। ওসি মানববন্ধনে থাকা শিক্ষার্থী ও সিফাতের নানাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন।’

সিফাতের নানা এনায়েত কবির হাওলাদার বলেন, ‘পুলিশের আজকের ভূমিকা খুবই দুঃখজনক। আমি এখন নাতিকে নিয়ে সংশয়ে আছি।’

এ ব্যাপারে ওসি ইলিয়াস বলেন, ‘আমাদের অনুমতি না নিয়ে কতিপয় দুষ্কৃতকারী সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করতেছে—এমন সংবাদ পেয়ে আমি মানববন্ধনটি বন্ধ করে দিই।’

এদিকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের পুলিশের বেপরোয়া লাঠিপেটার ঘটনা আড়াল করতে বামনা উপজেলা ছাত্রলীগ গতকাল বিকেল ৫টায় পাল্টা মানববন্ধনের আয়োজন করে। পুলিশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। তাতে বলা হয়, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকীর দিনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সিফাতের মুক্তির দাবিতে ওই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছিল। ওই মানববন্ধনে পুলিশ হামলা করেনি। বরং পুলিশের ওপরই হামলা চালানো হয়েছে।

ঢাকায় প্রতিবাদসভা : সিফাত ও শিপ্রার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে গতকাল রাজধানীতে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসের সামনে প্রতিবাদসভা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম ও মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ এবং স্টামফোর্ড ফিল্ম স্টুডেন্ট সিনে ফোরামের উদ্যোগে এই কর্মসূচি পালিত হয়। সভা শেষে একটি মৌন মিছিল বের হয়।

প্রতিবাদসভায় চার দফা দাবি তুলে ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সানাউল কবীর সিদ্দিকী। ওই দুই শিক্ষার্থীর মুক্তি ছাড়াও অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে মেজর (অব.) সিনহা হত্যার সুষ্ঠু বিচার, দুই শিক্ষার্থীকে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি এবং পরিবারসহ তাদের নিরাপত্তা প্রদান। সভা থেকে ওই দুই শিক্ষার্থীর মুক্তির আগ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

কটিয়াদীতে মানববন্ধন : মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার প্রতিবাদ এবং তাঁর সহযোগী সিফাত ও শিপ্রার বিরুদ্ধে দায়ের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার দাবিতে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে মানববন্ধন হয়েছে। গতকাল সকালে উপজেলা পরিষদের সামনে দীপশিখা গ্রন্থাগার আন্দোলন নামের একটি সংগঠন এই কর্মসূচি পালন করে। ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধনে সংগঠনের সদস্যসহ স্থানীয় সচেতন মানুষ অংশ নেয়।

মানববন্ধন থেকে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে কঠোর জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি করা হয়।

দীপশিখা গ্রন্থাগার আন্দোলনের সমন্বয়ক বদরুল আলম নাঈমের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্র চলচ্চিত্রকর্মী জিসান আজাদ, সঞ্জয় রায় তপু, সাকিবুল হাসান সোহাগ, এ কে এম মুশফিকুর রহমান রবিন প্রমুখ।