হিন্দিত্ববাদী সন্ত্রাসীদের দেওয়া আগুনে দিল্লি জ্বলছে। সেই আগুনে পুড়ে গেছে বহু মুসলিমের ঘর,মসজিদ । দায়িত্ব পালন না করা এবং বিজেপি কর্মীদের আগুন দেওয়ায় উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত দিল্লি পুলিশ। ৬৯ ঘণ্টা নীরব থেকে দিল্লিবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

থমথমে আতঙ্কের নগরে পরিণত হয়েছে উত্তর-পূর্ব দিল্লি। সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৪। যদিও পুরোপুরি মৃত্যু হয়নি মানবতার। উত্তর-পূর্ব দিল্লির অশোক নগরে পুড়ে যাওয়া ঘরহীন মুসলিম পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদেরই হিন্দু প্রতিবেশীরা। সেই ভ্রাতৃত্ববোধের মানবিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে।

অশোক নগরের ৪০ মুসলিম পরিবারের ঘর, আর জীবনযাত্রা একপ্রকার ধ্বংসই হয়ে গেছে। ধ্বংসাবশেষের মধ্যেও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে ঘরহীন মুসলিমদের কাছে টেনে নিয়েছেন হিন্দু বাসিন্দারা।

গত মঙ্গলবার এসব মুসলিমদের বাড়িঘর এবং দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন তাদের পাশে দাঁড়ান হিন্দু প্রতিবেশীরা। তারা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তাদের ঘরের দরজা খুলে দেন।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মঙ্গলবার দুপুর ১টার দিকে প্রায় এক হাজার উগ্র জনতা বড় মসজিদের কাছের কলোনিতে প্রবেশ করে। তারা যখন মসজিদে প্রবেশ করে, তখন সেখানে ২০ জন মুসল্লি নামাজরত অবস্থায় ছিলেন।

সেই পরিস্থিতির কথা বলেছেন স্থানীয় বাসিন্দা খুরশির আলম। তিনি বলেছেন, “আমি মসজিদেই ছিলাম। আমরা তখন জীবন বাঁচাতে দৌড়ে বের হয়ে যাই।”

উগ্র জনতা ভাঙচুর করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। স্থানীয় আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ তৈয়ব জানান, দুপুর দেড়টার দিকে ওরা মসজিদের ছাদে উঠে ভারতের এবং গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করে। বুধবার সকালে স্থানীয়রা এগুলো সরিয়ে ফেলে।

এ সময় স্থানীয়রা উগ্র জনতাকে কোনও সম্পত্তির ক্ষতি না করার অনুরোধ করে। সেই অনুরোধ কানেই নেয়নি তারা। তারা সবাই অন্য অঞ্চলের ছিলেন। অশোক নগরের বাসিন্দা রাজেশ খাত্রি বলেছেন, “উগ্রদের বেশিরভাগের মুখ ঢাকা ছিল। তাদের হাতে ছিল লোহার রড। তারা খুব দ্রুত দোকানপাট পুড়িয়ে দিতে শুরু করে। আমরা ভয়ে ছিলাম হয়তো আমাদের মেরে ফেলা হবে।”

দোকান পোড়ানোর পরে তারা ছয়টি বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা মো. রশিদ বলেছেন, “সেখানে মাত্র ছয় ঘর মুসলিম বাস করত। উগ্র জনতা তা নিশ্চিতভাবে জানত। কারণ তারা অন্যকোনও ঘরে আক্রমণ করেনি। তারা মুসলিমদের ঘর থেকে সব লুট করে নিয়ে গেছে। কিছুই ফেলে যায়নি। আমরা এখন গৃহহীন।”

তিনি আরও বলেছেন, “আমরা ভেবেছিলাম আমাদের রাস্তায় থাকতে হবে এবং আমাদের জীবনযাত্রা থেমে যাবে। কিন্তু, আমাদের হিন্দু বন্ধুরা আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করছে। ওরা আমাদের তাদের ঘরে থাকতে দিয়েছে।”

“আমরা এখানে ২৫ বছর একসঙ্গে বাস করছি। কখনো আমাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে একটুও মতবিরোধ হয়নি। আমরা সবাই একটি পরিবারের মতো বাস করি,” বলেছেন রশিদ।

রশিদের হিন্দু প্রতিবেশী পিন্টু। তিনি বলেছেন, “পরিস্থিতি যেমনই হোক আমরা তাদের পাশে দাঁড়াবো। আমরা কখনও তাদের সম্পত্তির ক্ষতি করার কথা ভাবতেও পারি না। যেসব দোকানে আগুন লাগানো হয়েছে তা এসব মুসলিম পরিবারের মালিকানাধীন। ফলে, তাদের বাড়িঘর ও জীবিকা নির্বাহের রাস্তা উভয়ই ধ্বংস হয়ে গেছে। এমন দুর্দশায় আমরা তাদের একা থাকতে দিতে পারি না।”

অশোক নগরের পাঁচ নম্বর গালির অপর বাসিন্দা নীরজ কুমার। তিনি বলেছেন, “আমরা কোনও হামলাকারীকে চিনতে পারিনি। আমরা অনেক বছর ধরেই এখানে একসঙ্গে বাস করছি। তাই আমরা একে অপরকে আঘাত করতে পারি না। এখানে দুইবার হামলা করা হয়। দুপুর ১টার দিকে একবার এবং বিকাল ৪টার দিকে আরও একবার।”

পুড়ে যাওয়া বাড়িগুলোর একটির মালিক দানিশ। তিনি বলেছেন, “আমরা কয়েকবার পুলিশকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু, তারা এক ঘণ্টা পরে আসে। ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ায় হয়ে গেছে। উগ্র জনতা বেশিরভাগ বাড়ি ভাঙচুর করেছে। পুলিশ তখন আমাদের পরিবারকে থানায় নিয়ে যায়। সেখানেই আমরা রাত কাটিয়েছি।”

উগ্র জনতার হামলায় শুধু মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, হিন্দুদেরও ক্ষতি হয়েছে। মসজিদের নিচে জুতা বিক্রি করতেন রাজ কুমার। তার দোকানটিও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, “তারা কাউকে ছাড়েনি। গত কয়েকদিন ধরে আমার দোকান বন্ধ ছিল। কিন্তু, অশোক নগরে এমন একটি ঘটনা ঘটবে তা ভাবতেই পারিনি। আমি বুধবার এসে দেখি আমার দোকানটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।”
এদিকে, দিল্লির সহিংসতায় দুর্বৃত্তদের সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহিংসতা বন্ধের চেষ্টা না করে উন্মত্ত জনতার সঙ্গে যোগ দিয়ে জয় শ্রী রাম বলে স্লোগান দিচ্ছিল পুলিশ। একই সঙ্গে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে তারা।

উল্লেখ্য, গত বছরের ডিসেম্বরে বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করে মোদি সরকার। তারপর থেকেই এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাসের পর থেকেই মুসলিমদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। সমালোচকদের দাবি, এই আইন ভারতের সংবিধানবিরোধী। এই আইনের কারণে মুসলিমরা আতঙ্কে আছেন যে, মোদির ভারতে তাদের হয়তো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হবে।