অপরাধ সংবাদ | তারিখঃ জানুয়ারি ২৭, ২০২০ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 454 বার
সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে সন্ধ্যার পর বের হয় তিনজন। একজন চালক। অন্য দুজন থাকে যাত্রীবেশে। গণপরিবহনের জন্য একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিরাই তাদের টার্গেট। অটোরিকশা কাছে নিয়ে চালক জানতে চায়, ‘কোথায় যাবেন?’ আগে থেকেই এক বা দুজন অটোরিকশায় বসে থাকে। টার্গেট ব্যক্তির গন্তব্য জানার পর গাড়িতে থাকা এবং পাশে থাকা ব্যক্তিরাও একই পথে যাওয়ার কথা জানান। চালক তখন যাত্রীবেশী দুই সহযোগীর সঙ্গে অচেনার মতোই ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষি করে। টার্গেট ব্যক্তি রাজি হলে ছদ্মবেশী এক যাত্রী বমি করা বা কোনো সমস্যার কথা বলে বাইরে বের হয়। এভাবে টার্গেট ব্যক্তিকে দুজনের মাঝে বসানো হয়। অটোরিকশা চালুর পর নির্জন এলাকায় দুই পাশ থেকে দুজন যাত্রীকে গামছা বা মাফলার দিয়ে বেঁধে ফেলে। শ্বাসরোধও করে। সঙ্গে থাকা টাকা, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে অন্ধকার এলাকায় ফেলে দেয়। এতে যাত্রীর মৃত্যু হলো নাকি, তা না দেখে পরবর্তী টার্গেট খুঁজে বেড়ায় দলটি। লুঙ্গি পরে অটোরিকশায় ওঠে তারা। পুলিশের সন্দেহের চোখ এড়াতে দিনমজুর ও সবজি ক্রেতার ছদ্মবেশও নেয়।
এভাবে রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়া থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত ১৬টি এলাকায় তিন বছর ওত পেতে থেকে অন্তত আড়াই হাজার ছিনতাই করেছে দুটি দল। গাজীপুরের ৮-৯ জনের এই চক্রের সদস্যরা দুই দলে তিনজন করে রাত ৮টার দিকে বের হয়। ভোরের আগে তারা দুই থেকে ছয়টি ছিনতাই করে। একটি দল গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত চারজনকে হত্যা করে কুড়িল ও কারওয়ান বাজার ফ্লাইওভারের ঢালে ফেলেছে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান মিজান (২৫) হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগ এই ভয়ংকর তথ্য পেয়েছে।
এই ছিনতাইকারীচক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর তারা সম্প্রতি ফ্লাইওভারে চারজনের লাশ ফেলা এবং আরো হত্যার তথ্য দেয়। তিন ছিনতাইকারী দলের একজন (সিএনজি অটোরিকশাচালক) নূর ইসলাম (৪০) গত শুক্রবার এবং ছিনতাইকৃত মোবাইল ফোনের বিক্রেতা জালাল (৩২) ও মোবাইল ফোনের ক্রেতা আব্দুল্লাহ বাবু (২৫) গতকাল ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা, ভাটারা থানা ও খিলক্ষেত থানায় দায়ের করা চার মামলায় পুরো চক্রটিকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছেন তদন্তকারীরা। পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, এই চক্রটি কখনো শনাক্ত বা গ্রেপ্তার হয়নি। এদের সিএনজি পার্টি বা সিএনজির গামছা পার্টি বলছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতদের বর্ণনায় গাজীপুর ও সাইনবোর্ড এলাকায় ছয়টি হত্যার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তদন্তকারীরা সন্দেহ করছেন, অনেক ব্যক্তিকে রাস্তায় ফেলার পর বাস বা ট্রাকে চাপা পড়ায় সড়ক দুর্ঘটনা বলে ধরে নেওয়া হতে পারে। চার হত্যার তদন্তে আরো অনেক ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা করছেন তাঁরা।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) বিপ্লব বিজয় তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, গত ৫ জানুয়ারি হাতিরঝিলের ফ্লাইওভারের কারওয়ান বাজার অংশে মিজানুর রহমানের লাশ পাওয়া যায়। আলামত দেখে ঘটনাটিকে হত্যাকাণ্ড ধরে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। নিহতের একটি মোবাইল ফোনসহ মানিব্যাগ নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। আর একটি ফোন ফেলে যায়। সিসি ক্যামেরা ফুটেজ ও ফোনের সূত্রে ছিনতাইকারীদের দলের এক সহযোগীকে আটক করে পুলিশ। এর সূত্রে লোমহর্ষক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ডিসি বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা, খিলক্ষেত, ভাটারা, গুলশান, বনানী, বাড্ডা, মহাখালী, রামপুরা, তেজগাঁও, হাতিরঝিল, মগবাজার, ৩০০ ফিট, কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী ও সাইনবোর্ড এলাকায় ওত পেতে থেকে একজন যাত্রীকে তারা তুলত। ডিসি আরো বলেন, ‘নূর ইসলাম জানিয়েছে সে ছয় মাস এই দলে কাজ করছে। বাকিরা তিন বছরেরও বেশি। প্রতি রাতে তারা দুই থেকে ছয়টি ছিনতাই করে। তার জানা মতে আড়াই থেকে তিন হাজার ঘটনা তারা ঘটিয়েছে।’
নূর ইসলামের বাড়ি চাঁদপুরের দক্ষিণ মতলবে। থাকেন গাজীপুরের গাজীপুরা এলাকায়।
ডিএমপির তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুক বলেন, ‘ভাটারা ও খিলক্ষেতের ঘটনার সঙ্গে ছয়টি ঘটনার প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। তারিখ ধরে স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় এগুলোও খোঁজা হবে। পুরো ছিনতাইকারী দলটিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি আমরা।’
পুলিশ জানায়, গত বৃহস্পতিবার গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তারের পর শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম বর্ধন চন্দ্র মণ্ডলের আদালতে দায় স্বীকার করে নূর ইসলাম। গতকাল বাবু হাকিম কনক বড়ুয়ার আদালতে এবং জালাল মামুনুর রশিদের আদালতে ছিনতাইচক্রে সহায়তার দায় স্বীকার করেছে।
জানা গেছে, গত ৯ ডিসেম্বর দিনগত রাতে ভাটারা থানাধীন কুড়িল ফ্লাইওভারের ওপর থেকে গলায় গামছা প্যাঁচানো অবস্থায় আক্তার হোসেনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের মফিজুর রহমানের ছেলে আক্তার ভাটারার খন্দকার বাড়ির মোরের মায়ের দোয়া কুমিল্লা জুয়েলার্সের মালিক ছিলেন। গত ৩ জানুয়ারি দিনগত মধ্য রাতে খিলক্ষেত থানাধীন কুড়িল ফ্লাইওভারের ওপর থেকে গলায় মাফলার প্যাঁচানো অবস্থায় মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের সততা স্কুল ড্রেস অ্যান্ড টেইলার্সে টেইলারিং মাস্টার মনির স্ত্রী শাহনাজ পারভিন হ্যাপীর সঙ্গে আশুলিয়ার জিরাবো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় থাকতেন। প্রথমে অজ্ঞাত থাকলেও পরে স্বজনরা তাঁদের লাশ শনাক্ত করে। পরে ৩১ ডিসেম্বর আরেকটি লাশ পাওয়া যায়, যার পরিচয় শনাক্ত হয়নি। এ ঘটনায় পুলিশ খিলক্ষেত থানায় মামলা করেছে।
লক্ষ্মীপুরের সবিলপুর এলাকার আমির হোসেনের ছেলে মিজান শেওড়া এলাকার মেসে থাকতেন। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় ভাই আরিফ হোসেন হাতিরঝিল থানায় হত্যা মামলা করেন।
নিহত আক্তার হোসেনের বাবা মফিজুর রহমান বলেন, ‘খুনি যারাই হোক তাদের কঠিন শাস্তি চাই।’
খিলক্ষেত থানার ওসি বোরহানউদ্দিন রানা বলেন, ‘অন্ধকার ও সিসি ক্যামেরা না থাকায় তদন্তে বেগ পেতে হয়েছে। তবে আমরাও ওই গামছা পার্টির ক্লু পেয়ে গিয়েছিলাম। একই চক্র চার ঘটনা ঘটিয়েছে।’
ভাটারা থানার ওসি মোক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমরাও হাতিরঝিলের সেই হত্যার তথ্য শুনেছি। তবে মামলার তদন্ত শনিবার ডিবিতে চলে গেছে। তারা এখন কাজ করবে।’
Leave a Reply