সৈয়দ সাদিকুর রহমান সাদিক। দুই বছর আগেও এই নামটি ছিল না ছাত্রলীগের ‘সিলেবাসে’। অচেনা এক সাদিক ৪০ লাখ টাকা খরচায় বাগিয়ে নেন সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ। পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ! পরে আর পেছনে তাকাননি। গড়ে তোলেন ‘সাদিক বাহিনী’। দুই হাতে অবৈধ অস্ত্র তুলে কামাচ্ছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ‘সাদিক বাহিনী’র সব কিছুই যেন চলচ্চিত্রকে হার মানায়। এলাকায় কথিত আছে, বাহিনীপ্রধান সাদিকের হৃৎপিণ্ডের ‘ডান অলিন্দ’ মাহামুদুর রহমান দীপ আর ‘বাম অলিন্দ’ ছিলেন সাইফুল ইসলাম। গত শুক্রবার ভোরে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সাইফুল-দীপ নিভে গেছেন। সাদিক হয়ে পড়েছেন একা। বাহিনী গুটিয়ে এখন নিজেই ফেরার।

দিনের আলো কিংবা রাতের আঁধার; কখনো প্রাইভেট কার আবার কখনো মোটরসাইকেল। সাতক্ষীরা শহরের ‘রংবাজ’ সাদিকের দলবল নিয়ে দাপুটে ঘোরাঘুরি সবাইকে অজানা শঙ্কায় ফেলত। দুই সহযোগী দীপ-সাইফুল থাকতেন ছায়া হয়ে। ঘনিষ্ঠ দুই ছায়াসঙ্গীর হঠাৎ এমন মৃত্যুতে সাদিকের চোখেও নোনা জলের রেখা পড়েছে। নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে সাদিক সঙ্গী হারানোর ব্যথা জানান দিয়েছেন। গত শনিবার সকালে এ বিষয়ে স্ট্যাটাস দেওয়ার পর তা ভাইরাল হয়ে যায়। ফেসবুকে তাঁদের জন্য দোয়া চেয়ে সাদিক বলেন, ‘আল্লাহ যেন তাদের বেহশতবাসী করেন।’

সাতক্ষীরা শহরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শহরের মুনজিতপুরের ময়নুল ইসলামের ছেলে মাহমুদুর রহমান দীপ (২৫) ও কালীগঞ্জের চাম্পাফুল ইউনিয়নের উজিরপুর গ্রামের সবুর সরদারের ছেলে সাইফুল ইসলামের (৩৮) হাতে অবৈধ অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন সাদিক। তাঁরা শহর ও শহরের অদূরে বিভিন্ন স্থানে মানুষকে ভয় দেখিয়ে নিতেন নানা সুবিধা।

সাদিকের যত রংবাজি : দুই বছর আগে ছাত্রলীগ সম্পাদক পদ পেয়ে তাঁকে নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার ‘নিয়ম’ চালু করেন। শহর ও শহরতলিতে টাকার বিনিময়ে অনেকের জমি দখলের কাজও করে দেয় ‘সাদিক বাহিনী’। সম্প্রতি শহরের বাইপাস সড়কের ধারে পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদুজ্জামান রাশির পৈতৃক জমি দখল করতে যান ছাত্রলীগ নেতা সাদিক। পরে অজানা কারণে ওই দখলবাজি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন সাদিক।

গত ৩ আগস্ট শহরতলির মাছখোলায় আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটির প্রয়াত সভাপতি আইউব আলীর স্ত্রী হোসনে আরার বাড়িসহ জমি অন্যকে দখল করে দেওয়ার চুক্তিতে সাদিক ক্যাডার নিয়ে সেখানে হামলা করেন। সে সময় দীপ-সাইফুল তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এ সময় অসাবধানতাবশত সাদিকের কাছে থাকা পিস্তলের গুলিতে আহত হন তাঁর অনুসারী ছাত্রলীগের আজমীর হোসেন ফারাবি। পরে গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে রাতেই তাঁরা সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। ওই সময় ঘটনা ছাইচাপা দিতে প্রচার করা হয়, ওই বাড়িতে শিবির ক্যাডাররা নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের প্রতিহত করতে তাঁর বাহিনী এই হামলা চালায়।

কিছুদিন আগে ভারতে পাচারের জন্য শহরে নিয়ে আসা সোনার একটি বড় চালান অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ছাত্রলীগ নেতা সাদিক সঙ্গীদের নিয়ে চোরাচালানিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন।

গত ৩০ মে সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবে দীপ-সাইফুলসহ অন্য সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে সাদিক সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালান। সব দরপত্রের ভাগ সাদিকের পকেটে যেতে হবে—এটাই সাতক্ষীরার রেওয়াজ। ভাগ না পেলে দরপত্র বাক্স ছিনতাই কিংবা সমঝোতার মাধ্যমে ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে বহু পুরনো।

এদিকে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত অনুসারীদের নিয়ে সাদিক আড্ডা বসান শহরের কামানগর এলাকার প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের আশপাশে। গত ১৯ মার্চ সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মাছ ব্যবসায়ী আনারুল ইসলামকে ফোনে ডেকে নেন সাদিক। প্রাণিসম্পদ অফিসের কাছে নিয়ে সাদিক তাঁর কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। এ সময় তাঁকে মারধর করে দুই লাখ টাকা কেড়ে নিয়ে বাকি টাকা পরে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ছেড়ে দেন। পরে আনারুল বিষয়টি আওয়ামী লীগের পৌর কমিটিকে জানিয়ে এ ঘটনায় সাতক্ষীরা থানায় মামলা করেন। সাদিকের সঙ্গী কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত দীপ ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি স্কুলের দপ্তরি সোহাগকে পিটিয়ে হত্যা করেন। দীপ সাদিকের বিশ্বস্ত হওয়ায় সে সময় ওই হত্যার ঘটনা বেশি দূর এগোয়নি। পরে সংসদ নির্বাচনের উত্তেজনায় তা চাপা পড়ে যায়।

২০১৮ সালের ২৬ মার্চ শহরের আলাউদ্দিন চত্বরে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যুবলীগের মনোয়ার হোসেন অনুকে সাদিকের নির্দেশে ছুরিকাঘাত করেন দীপ। এ ঘটনা নিয়ে তৎক্ষণাৎ তোলপাড় শুরু হলেও অজানা কারণে সেই ছুরিকাঘাতের ঘটনাও গতি হারায়।

দুই বছর আগে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগ পর্যন্ত সাদিক ছাত্রলীগের কোনো ওয়ার্ডেরও সদস্য ছিলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। চাউর আছে, ৪০ লাখ টাকা খরচ করে ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতাদের সন্তুষ্ট করে সাদিক এক বছর মেয়াদি কমিটির সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। এরই মধ্যে দুই বছর কেটে গেলেও আজও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়নি। এ ক্ষেত্রে তাঁর গাফিলতিকে দুষছেন নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগের উপজেলা নেতাদের কাছ থেকে জানা গেছে, সাদিক সাতটি উপজেলা ও একটি পৌর কমিটি বারবার ভাঙাগড়া করেছেন। টাকার অঙ্ক কষে কমিটি গঠন করে দেওয়ার পর দুই-তিন মাস যেতেই ওই কমিটি ভেঙে দিয়ে ফের নতুন কমিটি গঠন করে টাকা কামিয়েছেন তিনি। এসব বিষয়ে ছাত্রলীগ নেতারা স্থানীয় সাংবাদিক, এমনকি কেন্দ্রেও বারবার অভিযোগ করেছেন।

এদিকে শহরের মুন্সিপাড়ায় ফায়ার সার্ভিস অফিসের কাছে একটি ভাড়া বাড়িতে একাধিক তরুণী এনে আনন্দ-ফুর্তি করে আসছিলেন সাদিক। ব্যক্তিগত জীবনে সাদিক বিবাহিত। তাঁর অত্যাচার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে গেছেন অনেক আগেই।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমান সাদিক বলেন, ‘আমি অসুস্থ। দীপ ও সাইফুলের ঘটনা শুনে আমি মর্মাহত। ওরা আমার দেহরক্ষী নয়। ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাইয়ের মতো। তারা বিকাশ এজেন্টের টাকা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত কি না আমার জানা নেই। জমি দখলের ঘটনা সঠিক নয়। আমার কোনো বাহিনী নেই। যেসব কথা বলা হচ্ছে তাও সত্য নয়।’

ছাত্রলীগ সম্পাদক সাদিকের নামে মামলা : হত্যা ও ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত পিস্তল উদ্ধারের ঘটনায় সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমান সাদিকসহ চারজনের নামে গত শনিবার রাতে মামলা হয়েছে। ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক হাফিজুর রহমান বাদী হয়ে সদর থানায় মামলাটি করেন।

মামলার আসামিরা হলেন সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুরের সৈয়দ মোখলেছুর রহমানের ছেলে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমান সাদিক, একই গ্রামের মৃত আরশাদ আলী সরদারের ছেলে আজিজুল ইসলাম, শহরের রসুলপুর মেহেদীবাগের এস এম আনিসুর রহমানের ছেলে শামীম হাসান ও একই এলাকার মো. আব্দুল বারেকের ছেলে চৌকির আহম্মেদ বাবু। এঁদের মধ্যে আজিজুল ইসলামকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে সদর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সাদিকসহ আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে।

সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল দুপুরে প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, বিকাশ এজেন্টের ২৬ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের মাস্টারমাইন্ড হলেন সাদিক। বন্দুকযুদ্ধে নিহত দুজন ছিলেন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। এ পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের সঙ্গীদেরও খোঁজা হচ্ছে। শিগগিরই তাদের আইনে আওতায় আনা হবে।

উল্লেখ্য, বিকাশ এজেন্টের ২৬ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় গত বৃহস্পাতিবার দীপ ও সাইফুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে গত শুক্রবার ভোরে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন দীপ ও সাইফুল।উৎস -কালের কন্ঠ