কলাগাছকে বলা হয় ওষধি গাছ। কলার কাঁদি সংগ্রহের পর দ্বিতীয়বার এতে আর ফল ধরে না। গাছটি কেটে ফেলা হয়। নরম কাণ্ডের গাছটির আর কোনো ব্যবহার থাকে না। এবার ফেলনা সেই কলাগাছের আঁশই হয়ে উঠেছে মহামূল্যবান। এ থেকেই তৈরি হবে চেয়ার-টেবিলের মতো শক্ত আসবাব, ঢেউটিন, বিশেষ ধরনের কাগজ, কাপ, প্লেট, গ্লাস, হার্ডবোর্ড ও কার্টনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় আরও অনেক কিছু। প্রায় পাঁচ বছর ধরে এ নিয়ে গবেষণা করে আসছেন একদল তরুণ গবেষক। অবশেষে সাফল্যের মুখ দেখেছে তাদের প্রচেষ্টা। নমুনা হিসেবে কিছু পণ্য তৈরিও করা হয়েছে। এরই মধ্যে কারিগরি পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়েছে সেগুলোর গুণমান ও ব্যবহার উপযোগিতা। এখন শুধু বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরুর অপেক্ষা।

গবেষক দলের প্রধান সাগর দাস শিশির সমকালকে বলেন, বিকল্প উপাদান দিয়ে তৈরি এই পণ্যগুলো প্রচলিত পণ্যের চেয়ে শক্তিশালী ও পরিবেশবান্ধব হবে। উৎপাদন খরচও পড়বে কম। ফলে সুলভ মূল্যে তা পাবেন ভোক্তারা। পাশাপাশি এই শিল্প গড়ে উঠলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এ জন্য এখন সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের সহায়তা প্রয়োজন। আগ্রহী কোনো পক্ষ অর্থায়নে রাজি হলে অল্প দিনেই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করা সম্ভব।

২০১৪ সালের শেষের দিকে কলাগাছের ব্যবহার উপযোগিতা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বস্ত্র প্রকৌশল বিভাগের তৎকালীন ছাত্র সাগর দাস শিশির। তার বন্ধু রাকিবুল ইসলামও এ গবেষণায় অংশ নেন। পরে এ দলে যুক্ত হন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশিস সরকার ও আবু সাঈদ অমি। তাদের দলকে সব ধরনের সহায়তা দিয়ে এগিয়ে নেন বিশ্ববিদ্যালয়টির তখনকার সহকারী অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম। গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে এ নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সমকাল।

সংশ্নিষ্টরা জানান, গবেষণা শুরুর গল্পটা বেশ চমকপ্রদ। শিশির ও তার বন্ধু রাকিবুল একদিন কলা খেতে খেতে গল্প করছিলেন। এ সময় শিশির দাবি করেন, ফেলে দেওয়া কলাগাছ থেকে তৈরি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র। বন্ধুটি তার বিরোধিতা করেন। তাদের কথা শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাট গবেষক প্রকৌশলী মোসলেম উদ্দিন জানান, কলাগাছ ব্যবহার করে সত্যিই অনেক কিছু তৈরি করা সম্ভব। কীভাবে সেটা করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে কিছু পরামর্শও দেন তিনি। সেই থেকে শুরু হলো গবেষণা। কলাগাছের বাকল থেকে তৈরি হলো আঁশ। পরীক্ষায় দেখা গেল, এই আঁশ পাটের মতোই শক্তিশালী। ধীরে ধীরে গবেষণা এগিয়ে যায়। তবে দলের সবাই শেষ পর্যন্ত আগ্রহ ধরে রাখতে পারেননি। আশিস ও অমি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে এ গবেষণা ছেড়ে দেন। নতুন করে যুক্ত হন শিক্ষার্থী দিদার হোসেন ও শিব্বির হোসেন। তারা চেষ্টা চালিয়ে বছর দুয়েক আগে প্রথম সাফল্য পান। কলার আঁশ থেকে তৈরি হয় হার্ডবোর্ড। এরপর একে একে অন্য পণ্যগুলোও তৈরি করা সম্ভব হয়। তবে তৈরি করলেই তো হলো না, নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার আছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ল্যাবে তাই পণ্যগুলোর শক্তিমত্তা, তাপধারণ, পানি শোষণ, বাঁকানো ও চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখা হয়। তাতে সব মানদণ্ডেই কাঙ্ক্ষিত ফল মেলে। দেখা যায়, কলার আঁশের হার্ডবোর্ড এক হাজার কেজি বা তার বেশি ওজন বহন করতে পারে, যা অন্যান্য সাধারণ বোর্ডের চেয়ে অনেক বেশি। সেইসঙ্গে স্থিতিস্থাপকতা বেশি হওয়ায় এগুলো সহজে ভাঙবে না। পানিরোধী গুণের জন্য ভিজলেও পচবে না।

গবেষক দলের সদস্যরা জানান, এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্যই ছিল পরিত্যক্ত জিনিসকে কাজে লাগিয়ে ভালো কিছু তৈরি করা। দেশে কলাগাছ বেশ সহজলভ্য। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর অন্তত ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে কলা চাষ হয়। কলা সংগ্রহের পর ফেলে দেওয়া গাছগুলোই এ কাজে দরকার। কলাগাছের বাকল ৭ থেকে ১০ দিন পানিতে ডুবিয়ে রাখলে তা পচে যায়। তখন তা থেকে সংগ্রহ করা হয় আঁশ। পরে সেই আঁশ শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। অবশ্য এখন আধুনিক পদ্ধতিতে মেশিনের সাহায্যে অল্প সময়ে আঁশ পাওয়া সম্ভব। কলাগাছের আঁশ থেকে জিনিসপত্র তৈরির শিল্প গড়ে উঠলে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ শুধু আঁশ সরবরাহ করেও আয় করতে পারবেন। এরপর সেগুলো দিয়ে জিনিসপত্র তৈরির জন্য কারখানাতেও দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হবে। দেশে এখন প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিলের ছড়াছড়ি। অথচ প্লাস্টিক পরিবেশবান্ধব নয়। সে ক্ষেত্রে কলার আঁশের হার্ডবোর্ড দিয়ে কম খরচে বানানো চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করা যেতে পারে। টিন, প্লাস্টিক বা সিমেন্টের ঢেউটিনের জায়গা নিতে পারে কলার আঁশ থেকে তৈরি টিন। এই আঁশ থেকে বিশেষ ধরনের কাগজ তৈরি করা হয়েছে। এটি দিয়ে ওয়ান টাইম গ্লাস-প্লেট-কাপ বানানো যায়। এর মাধ্যমে প্লাস্টিকের প্লেট-গ্লাস ব্যবহারের পরিবেশগত ক্ষতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

তরুণ গবেষক দলটির অভিভাবকের ভূমিকায় থাকা আজহারুল ইসলাম এখন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি জানান, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় উৎসাহী কয়েকজন ছাত্র কলাগাছের আঁশ নিয়ে গবেষণা করতে চাইলে তিনি সহায়তা করেন। তখন বিশ্বের কয়েকটি দেশে এ নিয়ে গবেষণা শুরু হলেও বাংলাদেশে এটাই ছিল প্রথম। আনন্দের বিষয় হলো, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। এরই মধ্যে তারা কপিরাইট অফিস থেকে মেধাস্বত্ব সনদ পেয়েছেন। এখন এই গবেষণার ফল সাধারণ মানুষের কাজে লাগলেই তা সার্থক হবে।উৎস -সমকাল