সাংবাদিক জামাল খাশোগি, যাকে তুরস্কে সৌদি আরবের কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যা করা হয় ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর। প্রথমে সৌদি কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করলেও অবিলম্বে হত্যার বিষয়টি স্বীকার নেয়।

এবার তুরস্কের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ করা হল সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যার বিভৎস বিবরণ।

হত্যাকাণ্ডের কিছু সময় আগে থেকে তার দেহ টুকরো টুকরো করা পর্যন্ত পুরো সময়টার অডিও রেকর্ডিংয়ের লিখিত অনুলিপি প্রকাশ করেছে পত্রিকাটি।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ওই রেকর্ডিং সংগ্রহের পর দীর্ঘদিন ধরে বিশ্লেষণ শেষে এতে কী আছে তা সম্পর্কে রবিবার আদালতকে বিচারকাজের সময় নিশ্চিত করে। সোমবার সেটি জনগণের জন্য লিখিত আকারে প্রকাশ করে ডেইলি সাবাহ।

রেকর্ডিংটিতে ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট খাশোগির মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার ও ১৫ সদস্যের হত্যাকারী দলটির বিস্তারিত কথোপকথন রয়েছে।

তুর্কি প্রেমিকা হাতিস চেনগিজকে বিয়ের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসী জামাল খাশোগি ওইদিন তুরস্কে সৌদি কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন তার প্রথম বিয়ে ও তালাকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহের জন্য। বাগদত্তাকে অল্প সময়ের কথা বলে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে গেলেও আর কনস্যুলেট থেকে বের হননি খাশোগি।

প্রথম দিকে সৌদি সরকার অস্বীকার করলেও, পরে সৌদির পক্ষ থেকে কনস্যুলেটের ভেতরে ধস্তাধস্তির সময়ে খাশোগি নিহত হয়েছেন বলে স্বীকার করা হয়।

কিন্তু এই ব্যাখ্যা সত্য নয় বলে শুরু থেকেই দাবি করে এসেছে তুরস্ক। তুর্কি সরকারের দাবি, খাশোগির মৃত্যু একটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ছিল, যার ষড়যন্ত্র করেছিল খোদ সৌদি সরকার।

ধারাবাহিক তদন্তে তুরস্কের দাবিই একে একে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে।জামাল খাশোগি হত্যা-অডিওর লিখিত কপি প্রকাশ

রেকর্ডিংয়ের অনুলিপিতে বলা হয়েছে, ২ অক্টোবর খাশোগি কনস্যুলেট ভবনের ভেতর ঢুকতেই তার পরিচিত কেউ একজন তাকে অভিবাদন জানিয়ে টেনে একটি ঘরের ভেতর নিয়ে যান। ওই ব্যক্তিটি ছিলেন সৌদি আরবের একজন সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দেহরক্ষী মাহের আবদুল আজিজ মুতরেব।

ডেইলি সাবাহ জানায়, ভেতরে নিয়ে খাশোগিকে মুতরেব বলেন, ‘প্লিজ বসুন। আপনাকে আমাদের রিয়াদে নিয়ে যেতে হবে। ইন্টারপোল থেকে নির্দেশ এসেছে। ইন্টারপোল চায় আপনি ফিরে যান। আমরা আপনাকে নিতে এসেছি।’

জবাবে খাশোগি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে তো কোনও মামলা নেই। তাছাড়া আমার বাগদত্তা আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে।’

তারপর টানা আরও কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি হয় খাশোগি ও মুতরেবের মধ্যে। মুতরেব বারবারই জোর দিয়ে বলছিলেন খাশোগিকে তাদের সাথে যেতেই হবে। হত্যার আগের শেষ ১০ মিনিট মুতরেব বারবার খাশোগিকে চাপ দিচ্ছিলেন তার ছেলের জন্য মেসেজ রেখে যেতে যে, বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারলেও যেন খাশোগির ছেলে দুশ্চিন্তা না করেন।

খাশোগি ছেলের জন্য মেসেজ রেখে যেতে অস্বীকৃতি জানালে মুতরেব বলেন, ‘লিখুন মি. জামাল। জলদি করুন। আপনি আমাদের সাহায্য করুন যেন আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি। কেননা শেষমেশ ঠিকই আমরা আপনাকে সৌদি আরবে ফেরত নিয়ে যাবো আর আপনি যদি আমাদের সহায়তা না করেন তাহলে আপনি কিন্তু জানেন তখন কী হবে।’

ওই সময় ১৫ জন হিটম্যানের একজন জামাল খাশোগির দেহে চেতনানাশক ওষুধ ঢুকিয়ে দেন। জ্ঞান হারানোর আগে খাশোগির শেষ কথা ছিল, ‘আমার অ্যাজমা আছে। এমনটা করবেন না, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।’

এর কিছু সময় পর, স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৩৯ মিনিটে অডিও রেকর্ডে লাশ কাটার করাত দিয়ে ৫৯ বছর বয়সী সৌদি সাংবাদিকের দেহের অংশ বিচ্ছিন্ন করার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। প্রক্রিয়াটি প্রায় আধাঘণ্টা ধরে চলে।

খাশোগির মরদেহ বা দেহের অংশ এখনও উদ্ধার করা যায়নি।

রবিবার রিয়াদের একটি আদালতে চলমান মামলার শুনানিতে উত্থাপিত হত্যাকারী দলটির কথোপকথনের একটি অডিওর বক্তব্যও প্রকাশ করে ডেইলি সাবাহ।

অডিওতে খাশোগি কনস্যুলেট ভবনে প্রবেশের কয়েক মিনিট আগে মুতরেবকে সৌদি আরবের অন্যতম খ্যাতনামা ফরেনসিকস ডাক্তার সালাহ মোহাম্মদ আবদাহ তুবাইগিকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করতে শোনা যায়, ‘ট্রাংকটা কি একটা ব্যাগে ভরা সম্ভব হবে?’

জবাবে তুবাইগি বলেন, ‘না। অনেক ভারী। অনেক লম্বাও।’

তারপর তুবাইগি যোগ করেন, ‘আসলে, আমি সবসময় মৃতদেহ নিয়ে কাজ করেছি। আমি জানি খুব ভালো করে কীভাবে কাটতে হয়। অবশ্য কখনো উষ্ণ দেহ নিয়ে কাজ করিনি, তবে আমি সেটাও সহজেই সামলে নিতে পারব।’

‘আমি সাধারণত লাশ কাটার সময় আমার কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনতে থাকি। মাঝে মাঝে আমার কফিতে একটু চুমুক দেই আর ধূমপান করি। আমি এটাকে (খাশোগি) টুকরো করার পর তোমরা অংশগুলোকে প্লাস্টিক ব্যাগে মুড়ে সুটকেসে ঢুকিয়ে ফেলবে এবং বাইরে বের করে নিয়ে যাবে,’ বলেন তুবাইগি।