বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি সেক্টরে যখন দুর্নীতি মহামারী আকার ধারণ করেছে, তখন দুদক নীরব ভূমিকা পালন করছে। কারণ ক্ষমতাসীনদের দিকে তাকানো যাবে না।’ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমালোচনা করে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘এই দুনীতি দমন কমিশন এমন আরব্য রজনীর একচোখা দৈত্য, যে তার এক চোখ দিয়ে বিরোধী দলকে দেখে। নিশিরাতের নির্বাচনে ক্ষমতা নেয়া সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও ছত্রছায়ায় দেশে দুর্নীতির মচ্ছব চলছে। সেখানে অন্যায় না থাকলেও জোর করে সরকার যা বলে তারা তাই দেখে। অন্যদিকে কিছুই দেখতে পায় না। আমরা মনে করি, এই দুদকের চোখটি তৈরি করে দিয়েছে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। তার হাত-পা শাসক দলের কাছে বাঁধা রয়েছে। এই দুদক কি করছে আজকে জাতি জানতে চায়।’

দুদকের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, দুদকের হাত-পা বর্তমান শাসক দলের কাছে বাঁধা রয়েছে। এই দুদক কী করছে? আজকে জাতি জানতে চায়। আমরা এ-ও মনে করি শাসক দলের লোকজন এই প্রতিটি দুর্নীতি আর লুটপাটে জড়িত। ফলে পত্রপত্রিকা ও মিডিয়া যখন এই দুর্নীতি যতটুকু পারছে প্রকাশ করছে। এরপরও এই সরকারের টনক নড়ে না। কারণ মধ্যরাতে নির্বাচন করে দম্ভে ও গর্বে এই সরকার আত্মস্ফীত, সেজন্য লাগামহীন দুর্নীতি হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য চেষ্টা করে সরকারের ঊর্ধ্বতনরা। এতে জনগণের মধ্যে চাপা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের একজন মন্ত্রীই বলেছিলেন, সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খেতে। কারণ সুযোগ সন্ধানীর রাজনীতির খেলায় প্রধানমন্ত্রী নিজেদের লোকদের দেশটাকে লুটে নিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা করার সুযোগ দিচ্ছেন।’

রিজভী বলেন, ‘বর্তমানে দুর্নীতি আর লুটপাটের রাজত্বে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। দুর্নীতি এখন মহামারি রূপ ধারণ করেছে। দেশের আর্থিক খাত আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ধুঁকছে। বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের ব্যাপারে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে, যা ১২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে শোকে দুঃখে কৃষক ধান পুড়িয়ে দেয়, কোরবানির চামড়ার ন্যায্য মূল্য না পেয়ে মানুষ চামড়া মাটির নিচে পুঁতে রাখে, অথচ দেশের সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে চলছে হরিলুট। ব্যাংকগুলো পরিণত হয়েছে লুটেরাদের মানিব্যাগে। দেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা এই ঋণ খেলাপি হওয়ায় তাদের পক্ষে সাফাই গাইছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত পহেলা সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাংকগুলোতে সুদের হার বেশি হওয়ার কারণে নাকি সবাই ঋণ খেলাপি হচ্ছে। সরকারপ্রধানের কাছ থেকে এমন প্রশ্রয় পাওয়ার কারণে ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে এখন মূলধন সংকট দেখা দিয়েছে। টাকা পাচারকারী, ব্যাংক ডাকাত আর ঋণ খেলাপিদের বেপরোয়া লুটপাটে দেশের ব্যাংকগুলো প্রায় দেউলিয়া। শেয়ার বাজারের লুটপাট ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করে দিচ্ছে, অথচ সরকার নির্বিকার। লুটপাটের কারণে গত কয়েক মাসে শেয়ার বাজার থেকে বিদেশীরা ৬০০ কোটি টাকা পুঁজি প্রত্যাহার করে নিয়েছে।’

বিভিন্ন সেক্টর ও প্রকল্পে দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে রিজভী বলেন, ‘গত মে মাসে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফ্ল্যাটের জন্য ৬ হাজার ৭১৭ টাকায় একেকটি বালিশ ক্রয়ের মহাদুর্নীতিসহ ৩৬ কোটি টাকার বেশি লুটপাটের ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর এবার দুর্নীতির বিশ্বরেকর্ড গড়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর আর ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে আড়াল করাতে একটি পর্দা কিনতে দাম দেখিয়েছে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। ইতিমধ্যে হাসপাতালটির যন্ত্র ও সরঞ্জাম কেনাকাটাতেই অন্তত ৪১ কোটি টাকার দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নাগরিক টিভির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আপনারা দেখেছেন, হাসপাতালের একটি অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্ট কেনার খরচ দেখানো হয়েছে ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। একটি ভ্যাকুয়াম প্ল্যান্ট ৮৭ লাখ ৫০ হাজার, একটি বিএইইস মনিটরিং প্ল্যান্ট ২৩ লাখ ৭৫ হাজার, তিনটি ডিজিটাল ব্লাড প্রেসার মেশিন ৩০ লাখ ৭৫ হাজার, আর একটি হেড কার্ডিয়াক স্টেথেসকোপের দাম ১ লাখ ১২ হাজার টাকা। এমন অবিশ্বাস্য দামে ১৬৬টি যন্ত্র ও সরঞ্জাম কিনেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটির ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৪৬৫ টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনাকাটায় বিল দেখানো হয়েছে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা। হাসপাতালের শীর্ষ কর্মকর্তারাও এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। বই ক্রয়ে রীতিমতো পিলে চমকানো দুর্নীতি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সাড়ে ৫ হাজার টাকা দামের একটি বই স্বাস্থ্য অধিদফতর কিনেছে সাড়ে ৮৫ হাজার টাকায়! গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিক্যাল কলেজের জন্য ‘প্রিন্সিপাল অ্যান্ড প্র্যাকটিস অব সার্জারি’ নামক সার্জারির পাঠ্যবইয়ের ১০টি কপি কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ১০ কপি বইয়ের মোট দাম পরিশোধ করা হয়েছে ৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকায়। শুধু এই একটি আইটেমের বই-ই নয়, দুটি টেন্ডারে ৪৭৯টি আইটেমের ৭ হাজার ৯৫০টি বই কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এসব বইয়ের মূল্য বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৬ কোটি ৮৯ লাখ ৩৪ হাজার ২৪৩ টাকা।’

রিজভী বলেন, ‘নানা প্রকল্পের নামে ক্ষমতাসীন দলের লুটেরাদের কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হয়ে এখন প্রশাসনের লোকজনও জড়িয়ে পড়েছে স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতিতে। হারিয়ে গেছে জবাবদিহিতা আর শৃংখলার সব রীতিনীতি। পুকুর কাটা শিখতে রাজশাহীর বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ১৬ কর্মকর্তা রাষ্ট্রের ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয় করে ইউরোপ সফরে যাচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আবার মশা মারা শিখতে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। সিলেট বিভাগে বক্স-কালভার্ট বানাতে কনসালটেন্সি বাবদ খরচ করা হয়েছে দেড় কোটি টাকা! গত চার বছরের বেশি সময় নিয়ে ঢাকা ওয়াসার একটি পানি পরিশোধন প্রকল্প শেষ হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সম্প্রতি এই প্রকল্পটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফেটে গেছে পানির পাইপ। ইতোমধ্যে সিলেটের এক কারা কর্মকর্তার বাসায় ঘুষের ৮০ লাখ টাকা পাওয়া, স্বাস্থ্য বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির আবজল দম্পতির দেড় হাজার কোটি টাকার সম্পদের কাহিনী হারিয়ে যেতে না যেতেই রূপকথার পর্দার কাপড়, পুকুর খনন শিক্ষা, বই কাহিনি আর মশা মারা শেখার নামে বিদেশে বিনোদন ভ্রমণের খবর ফাঁস হয়েছে।’

এ সময় বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবুল খায়ের ভুঁইয়া, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সালাম আজাদ, মুনির হোসেন, আবদুল আউয়াল খান, আমিনুল ইসলাম, মীর হেলাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।