ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করা নিয়ে ব্রিটেন এক বিরল সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথা ভেঙে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সরকার আগামী কয়েক সপ্তাহের জন্য পার্লামেন্টে কার্যক্রম স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ রক্ষা করে পার্লামেন্ট স্থগিত করেছেন। এর ফলে এমপিরা জনসনের চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবেন না। এ সিদ্ধান্তকে ‘চূড়ান্ত ব্রিটিশ ক্যু’ বলছেন বিরোধীরা। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন। রানি ১৪ অক্টোবর পার্লামেন্টে ভাষণ দিতে পারেন। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ব্রিটেনকে ইইউ ত্যাগ করতে হবে। এদিকে জনসনের বিরোধিতা করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক এবং রূপা হক।

পার্লামেন্ট স্থগিতে বরিসের অনুরোধে সাড়া রানির

পার্লামেন্ট যাতে নিজের চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের পথে বাধা সৃষ্টি না করতে পারে তা নিশ্চিত করতে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত পার্লামেন্টের ক্ষমতা যতোটা সম্ভব সীমিত রাখতে চান প্রধানমন্ত্রী। অধিবেশন স্থগিতে তার আবেদনে সাড়া দিয়েছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সেপ্টেম্বরের শুরুতে স্থগিত হবে পার্লামেন্ট। তবে তা ৯ সেপ্টেম্বরের আগে এবং ১২ সেপ্টেম্বরের পরে করা যাবে না। গ্রীষ্মকালীন বিরতির পর সেপ্টেম্বরে পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরুর কয়েকদিন পরই তা স্থগিত করতে রানির কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, অধিবেশন স্থগিতের সময় শেষ হওয়ার পর ১৪ অক্টোবর নতুন অধিবেশন শুরুর প্রথম দিনে রানি পার্লামেন্টে ভাষণ দেবেন। ১০ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টের পরবর্তী অধিবেশন বসার কথা। কিন্তু রানি স্থগিত করায় অধিবেশন পাঁচ সপ্তাহের জন্য বসছে না। অর্থাত্ জনসনের ৩১ অক্টোবর চুক্তিহীন ব্রেক্সিট ঠেকাতে কোনো আইন পাশ করানোর সময় পাচ্ছেন না এমপিরা। অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিরোধীরা।

চরম ক্ষুব্ধ বিরোধীরা

বিরোধীরা মনে করছেন, চুক্তিহীন ব্রেক্সিট কার্যকরে বিরোধীদের হস্তক্ষেপে যেন পার্লামেন্টে আটকে না যায় সেজন্যই অধিবেশন স্থগিত করার বিরল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধান বিরোধীদল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের গণতন্ত্রকে চরম হুমকির মুখে ফেলেছেন। হাউস অব কমন্সের স্পিকার জন বারকো মন্তব্য করেছেন, এটা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল হবে। স্কটল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নিকোলা স্টারজন বলেন, প্রধানমন্ত্রী স্বৈরশাসকের মতো আচরণ করছেন। এমপিরা প্রধানমন্ত্রীকে ঠেকাতে না পারলে ব্রিটেনের সংসদীয় গণতন্ত্রের মৃত্যু হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে তারা ব্যর্থ হলে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট আনতে পারেন বিরোধীরা। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বরিসের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা জেরেমি করবিনের পক্ষে কঠিন হবে। কারণ বরিস ঠিকই করছেন।

যা বলছেন বরিস জনসন

প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, ব্রেক্সিটের সঙ্গে পার্লামেন্ট স্থগিত রাখার কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারের সংসদীয় কার্যক্রমের স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে জনসন বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে সরকারে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান না।

আইনত কি বৈধ?

হ্যাঁ আইনগতভাবে ঠিক আছে। এক অধিবেশন শেষ এবং অন্যটি শুরুর আগে স্থগিত থাকে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। লন্ডনে ব্রিটিশ রাজনীতির বিশ্লেষক ড. মুশতাক খান বিবিসিকে বলেন, এ ধরনের সংকট ব্রিটেনের বহু বছরের রাজনীতির ইতিহাসে খুবই বিরল। তার মতে, বিরোধীদের পক্ষে তেমন কিছু করা কঠিন, কারণ প্রধানমন্ত্রী আইন মেনেই সবকিছু করছেন। যদিও সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজরসহ অনেকেই আইনি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ভবিষ্যতে যা হতে পারে

আগামী ৩ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টের অধিবেশন বসে স্থগিত থাকবে এবং পরে আবার ১০ সেপ্টেম্বর বসার কথা ছিল। কিন্তু রানির সিদ্ধান্তে তা স্থগিত থাকবে। ১৪ অক্টোবর নতুন অধিবেশন বসবে যা ইইউ ত্যাগের সময় থেকে আড়াই সপ্তাহ আগে। ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যদি বিরোধী এমপিরা অনাস্থা ভোটে জয়লাভ করতে পারেন তাহলে অক্টোবরেই সাধারণ নির্বাচন হবে। আর রক্ষণশীল দল নির্বাচনে জিতলে ব্রেক্সিট কার্যকর হবে। কারণ দলটি গত সপ্তাহের মতামত জরিপেও লেবার পার্টির চেয়ে এগিয়ে ছিল।

চুক্তিহীন ব্রেক্সিট কী?

সোজা কথায়, এত বড়ো পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে দেশটির বিভিন্ন খাত ও জনগণকে কিছুটা সামলে নেওয়ার সময় দিতে ইইউর সঙ্গে কোনো সাময়িক চুক্তি ছাড়া বিদায় নিতে হবে। দেশটিকে ইইউর একক মুদ্রা বাজারব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ইইউ আদালত অথবা পুলিশ এমন সংস্থা থেকে দেশটিকে বেরিয়ে আসতে হবে। ইইউর বার্ষিক বাজেটে যুক্তরাজ্যকে অর্থ দিতে হবে না। বর্তমানে বছরে এর পরিমাণ ৯০০ কোটি পাউন্ড।

বাণিজ্যে ও ব্যক্তির ওপর প্রভাব

যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করেন। ইইউ ও ব্রিটেনের মধ্যে বাণিজ্য হবে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী। পণ্যে পালটাপালটি শুল্ক আরোপ হবে। বন্দরে বা সীমান্তে দুই পক্ষের পণ্য প্রবেশের আগে কড়াকড়ি হবে। ইইউভুক্ত দেশগুলোতে ভিসামুক্ত যাতায়াতের সুবিধা হারাবেন ব্রিটিশরা। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব পড়বে। ইইউভুক্ত দেশের যে কেউ স্বাস্থ্যগত সমস্যায় পড়লে ‘ইউরোপিয়ান হেলথ ইন্স্যুরেন্স কার্ড’ নামে বিশেষ বিমাব্যবস্থায় সদস্যদেশের সরকারি হাসপাতালে বিনা পয়সায় চিকিত্সার সুবিধা পান। সেটি আর থাকবে না ব্রিটিশদের জন্য। ব্রিটিশদের মোবাইল ফোনে রোমিং চার্জ আরোপ হতে পারে। ব্রিটেনের ড্রাইভিং লাইসেন্স আর ইইউতে কার্যকর থাকবে না।

সমস্যা ব্যাকস্টপ পদ্ধতি নিয়ে

ব্রিটেন একটা দ্বীপপুঞ্জ। ইউরোপ ও ব্রিটেনের মধ্যে আছে সমুদ্র ইংলিশ চ্যানেল এবং নর্থ সি। এই সাগরই সীমান্ত; কিন্তু একটি-দুইটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। যেমন আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড মিলে একটি আলাদা দ্বীপ। উত্তর আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের অংশ। আর আইরিশ প্রজাতন্ত্র একটি পৃথক দেশ এবং ইইউর সদস্য। এ দুইয়ের মধ্যে আছে স্থল সীমান্ত। তাই ব্রেক্সিটের পর এটিই পরিণত হবে ইউরোপ ও ব্রিটেনের স্থল সীমান্তে। ব্রিটেন ইইউ ছাড়লে এ সীমান্তে কাস্টমস চৌকি বসাতে হবে। আয়ারল্যান্ড আর উত্তর আয়ারল্যান্ডের মধ্যে যত মানুষ ও পণ্য এখন মুক্তভাবে চলাচল করে তখন তা আর থাকবে না। বিরোধীদের আপত্তি, এতে দেশের দুই অংশের জন্য দুই রকম নিয়ম হবে। ব্রিটেন ইইউ ছাড়লেও এর উত্তর অংশ উত্তর আয়ারল্যান্ড ইইউর আইনের কাঠামোর মধ্যেই থেকে যাবে। প্রধানমন্ত্রী জনসন ব্যাকস্টপ বাতিল করার কথা বললেও ইইউ রাজি নয়।
—তথ্যসূত্র : বিবিসি, রয়টার্স ও সিএনএন