আজ রক্তাক্ত ভয়াল-বিভীষিকাময় ২১শে আগস্ট । দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২১ আগস্ট একটি কলঙ্কময় দিন। ।২০০৪ সালের আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ১৫তম বার্ষিকী। আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে ‘সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ দলের ২৪ নেতা-কর্মী নিহত হন। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান সেসময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো গ্রেনেড হামলা মামলায় হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত, রায়সহ বই) তৈরির কাজ চলছে। আর এ পেপারবুক তৈরি হলে দ্রুত শুনানির জন্য আবেদন করবে রাষ্ট্রপক্ষ। এমনটি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বিচারিক আদালত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন। একইসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মামলার আসামি) তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে অপর আরও ১১ আসামিকে।
পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর এ মামলার বিচারিক আদালতের রায় প্রয়োজনীয় নথিসহ হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় এসে পৌঁছায়। এই মামলার বিচারিক আদালত থেকে দণ্ড পাওয়া ৪৪ জন আসামি আপিল করেছেন। সেই আপিল শুনানির জন্য উদ্যোগ নেয়ার আগে পেপারবুক প্রস্তুতির কাজ চলছে হাইকোর্ট বিভাগের একজন ডেপুটি রেজিস্ট্রারের তত্ত্বাবধানে।
শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এ সিরিজ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ঢাকার তখনকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী তাৎক্ষণিকভাবে মানব ঢাল তৈরি করে তাকে গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা করেন। এ ঘটনায় আহত হন আওয়ামী লীগের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী, যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন, কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
বর্বরোচিত এ গ্রেনেড হামলায় নিহতরা হলেন- আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব:) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন এবং ইসাহাক মিয়া।

মারাত্মক আহতরা হলেন শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, প্রায়ত আব্দুর রাজ্জাক, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, এডভোকেট সাহারা খাতুন, মোহাম্মদ হানিফ, এ এফ এম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা পারভীন, এডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, নাসিমা ফেরদৌস, শাহিদা তারেক দিপ্তী, রাশেদা আখতার রুমা, হামিদা খানম মনি, ইঞ্জিনিয়ার সেলিম, রুমা ইসলাম, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন, মামুন মল্লিক প্রমুখ।

অভিযোগ আছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের এই হত্যাকান্ডের প্রতিকারের ব্যাপারে তৎকালীন বিএনপি সরকার নিলিপ্ত ভ’মিকা পালন করেছিল। শুধু তাই নয় এ হামলার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের রক্ষা করতে সরকারের কর্মকর্তারা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত পাঁচটি গ্রেনেড ধ্বংস করে দিয়ে প্রমান নষ্ট করার চেষ্টাও করা হয়েছিল।

পরবর্তি সময়ে নতুন করে তদন্ত শুরু হলে বিএনপি সরকারের প্রভাবশালী স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুরজ্জামান বাবর ঘটনার সাথে তারেক রহমান জড়িত আছেন বলে দাবি করে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাধর বড় পুত্র তারেক রহমান ‘ এ হামলার ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন।’

এই হামলার সাথে জড়িত ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীর সন্ধানদাতার জন্য সেসময় বাবর এক কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। হামলার পর বাবরের তত্বাবধানে একটি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় এবং এতে জজ মিয়া নামে এক ভবঘুরে, একজন ছাত্র, একজন আওয়ামী লীগের কর্মীসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ পরবর্তী তদন্তে তাদের কারো বিরুদ্ধেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুকুল পরিস্থিতিতে সরকার এ হামলার পুনারায় তদন্তের নির্দেশ দিলে এবং সাড়ে তিন বছর পর বিলম্বিত পুলিশ চার্জ শিট নথিভুক্ত করা হয়। অথচ বিএনপি’র কতিপয় সংসদ সদস্য এই জঘন্য হামলাকে আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত হামলা বলে দাবি করেছিল।

পুনরায় তদন্তে পুলিশ এই হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ২১ জনকে চিহ্নিত করে। এর আগে বেশ কয়েকটি বিদেশী মিশন যেমন ব্রিটিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, ইউএস ফেডারেল ব্যুারো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এবং ইন্টারপোল বাংলাদেশী তদন্তকারীদের যোগ দিলেও এসব প্রতিষ্ঠান বিএনপি সরকার তাদের সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ করেছিল।