বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ জহির রায়হান। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার। এই গুণি ব্যক্তির জন্মদিন আজ। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জহির রায়হান।

জহির রায়হান দেশের বিভিন্ন শাখায় অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য গল্প শাখায় তিনি ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৭৭ সালে (মরণোত্তর) একুশে পদক এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেন। এছাড়া চলচ্চিত্রে তার সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে ১ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে মরণোত্তর বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

জহির রায়হানের রচিত প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল ‘হাজার বছর ধরে’ ও ‘আরেক ফাল্গুন’। ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটির জন্য ১৯৬৪ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ নির্মিত হয় ১৯৬১ সালে। আর ১৯৬৪ সালে ‘কাঁচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি নিগার পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর নির্মিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হল- বেহুলা, সঙ্গম, আনোয়ারা এবং জীবন থেকে নেওয়া।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র তুলে ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্য চিত্র নির্মিত করেন জহির রায়হান। যা বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে।

জহির রায়হান ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু হয় ১৯৫০ সালে যুগের আলো পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন।

চলচ্চিত্র জগতে জহির রায়হানের পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে। ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি ‘যে নদী মরুপথে’তেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাঁকে ‘এ দেশ তোমার আমার’-এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। জহির রায়হান এ ছবির নামসঙ্গীতও রচনা করেছিলেন।

১৯৬১ সালে তিনি রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন উর্দু ভাষায় এবং পরের বছর তাঁর প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ মুক্তি পায়।

জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তাঁর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ছবিতে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানেও অংশ নেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন।

কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’র বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন।

সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।

স্বাধীনতার পর তাঁর ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন তিনি। ভাইয়ের সন্ধানে মীরপুরে যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি জহির রায়হান। ১৯৭২ এর ৩০ জানুয়ারির পর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মনে করা হচ্ছে ছদ্মবেশী পাকিস্তানী বিহারীরাই তাঁকে হত্যা করেছে।

ব্যক্তি জীবনে জহির রায়হানের ছিল দুই স্ত্রী। একজন সুমিতা দেবী অন্যজন সুচন্দা। প্রথম স্ত্রীর ঘরে দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত নাট্য নির্মাতা। স্ত্রী সুচন্দার ঘরে আরেক ছেলে তপু রায়হানও অভিনেতা।তথ্যসূত্র-একুশে টিভি