স্ত্রীর উপর অভিমান করে ডা. মোস্তফা মোরশেদ আকাশ (৩২) নামে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের এক চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন। বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে ওই চিকিৎসককে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

চন্দনাইশ উপজেলার বরকল বাংলাবাজার এলাকার মৃত আবদুস সবুরের ছেলে ডা. আকাশের সঙ্গে ২০০৯ সালে পরিচয় হয় তানজিলা চৌধুরী মিতুর। এর পর তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৬ সালে তারা বিয়ে করেন।

মৃত্যুর এক ঘণ্টা আগে তিনি নিজের ফেসবুকে স্ত্রীর উদ্দেশে একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাসটিতে স্ত্রীর প্রতি তার অভিমান ও ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে।

ডা. আকাশ স্ট্যাটাসে স্ত্রীর উদ্দেশে লেখেন- ‘ভালো থেকো, আমার ভালোবাসা তোমার প্রেমিকাদের (প্রেমিকদের) নিয়ে।’

চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার জানান, চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের (১৩ নম্বর ওয়ার্ড) চিকিৎসক ছিলেন ডা. আকাশ। সকালে তার ভাই নেওয়াজ মোরশেদ চান্দগাঁও আবাসিকের বি-ব্লকের ২ নম্বর সড়কের ২০ নম্বর বাসা থেকে গুরুতর অবস্থায় তাকে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। ধারণা করা হচ্ছে, ইনসুলিনের সাহায্যে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

নিহত আকাশ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বরকল এলাকার মৃত আবদুস সবুরের ছেলে। তিনি এমবিবিএস শেষ করে এফসিপিএস পড়ছিলেন। এর আগে নিজের ফেসবুকে আরও কয়েকটি স্ট্যাটাস দেন আকাশ। যেগুলো দেখলে যে কেউ বুঝবেন, আকাশ প্রচণ্ড অভিমান থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। স্ত্রীর আচরণে বিরক্ত ছিলেন তরুণ এ চিকিৎসক। স্ত্রীর চরিত্র নিয়েও খোলামেলা লিখেছেন তিনি। স্ত্রী তানজিলা হক মিতুর প্রতি পরকীয়া ও অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগ তোলেন আকাশ।

একটি স্ট্যাটাসে ডা. আকাশ লেখেন- ‘আমার সাথে তানজিলা হক চৌধুরী মিতুর ২০০৯ সাল থেকে পরিচয়। প্রচণ্ড ভালোবাসি ওকে। ও নিজেও আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমরা ঘুরে বেড়াই, প্রেম করে বেড়াই আমাদের ভালোবাসা কমবেশি সবাই জানে। আমাকে অনেকে বউ পাগলাও ডাকত।’
আকাশ লেখেন,‘২০১৬-তে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েক দিন আগে জানতে পারি- কিছু দিন আগে শোভন নামে চুয়েটের ৮ম ব্যাচের এক ছেলের সাথে ও হোটেলে রাত কাটায়; আর কত কি লজ্জা লাগছে সব লিখতে। ততদিনে সবাইকে বিয়ের দাওয়াত দেয়া শেষ। আমাকে যেহেতু চট্টগ্রামের সবাই চিনে, তাই বিয়ে কেনসেল (বাতিল) করতে পারিনি লজ্জাতে।’

‘ওর মোবাইলে দেখি, ভাইবারে দেখতে পাই মাহবুব নামে কুমিল্লা মেডিকেলের ব্যাচম্যাটের সাথে হোটেলে …শত শত ছবি। আমি তো বেঁচে থেকেও মৃত হয়ে গেলাম। তার পর ক্ষমা চাইল (স্ত্রী) শবেকদরের রাতে কান্না করে পা ধরে আর কখনো এমন হবে না। আমিও ক্ষমা করে দিয়ে এক বছর ভালভাবেই সংসার করলাম।’

স্ত্রী সম্পর্কে আকাশ লেখেন-‘তারপর ও দেশের বাইরে আমেরিকা গেল, মাঝখানে একবার ঈদ পালন করতে আসল সেপ্টেম্বরে ২০১৮ আবার চলে গেল ইউএসএমএলই এর প্রিপারেশন নিচ্ছিল। সাথে ফেব্রুয়ারিতে ২০১৯ এ আমার ইউএসএ যাওয়ার কথা।’

আকাশ আরও লেখেন-‘জানুয়ারি ২০১৯ জানতে পারি ও রেগুলার ক্লাবে যাচ্ছে মদ খাচ্ছে- প্যটেল নামে এক ছেলের সাথে…। আমি বারবার বলছি- আমাকে ভাল না লাগলে ছেড়ে দাও কিন্তু চিট করো না মিথ্যা বলো না। আমার ভালোবাসা সবসময় ওর জন্য ১০০% ছিল। আমি আর সহ্য করতে পারিনি। আমাদের দেশে তো ভালোবাসায় চিটিং এর শাস্তি নেই। তাই আমিই বিচার করলাম, আর আমি চির শান্তির পথ বেছে নিলাম।’

‘তোমাদেরও বলছি- কাউকে আর ভালো না লাগলে সুন্দরভাবে আলাদা হয়ে যাও চিট করো না মিথ্যা বলো না। আমি জানি অনেকে বিশ্বাস করবে না এত অমায়িক মেয়ে আমিও এসব দেখে ভালোবেসে ছিলাম। ভিতর বাহির যদি এক হতো। সবাই আমার দোষ দেবে সবকিছুর জন্য তাই ব্যাখ্যা করলাম।’

‘আমার শাশুড়ি এর জন্য দায়ী এসবের জন্য, মেয়েকে আধুনিক বানাচ্ছে। একটু বেশি বানিয়ে ফেলেছে। উনি চাইলে এখনো সমাধান হতো। মা তুমি মাফ করে দিও তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম না। মায়ের ভালোবাসার কখনো তুলনা চলে না।’

‘বারবার বলছি- ভালো না লাগলে আলাদা হয়ে যাও চিট করো না, মিথ্যা বলো না বিশ্বাস ভাঙ্গিও না। হাজার হাজার ছবি আছে, আরো খারাপ খারাপ দিলাম না, যারা বিলিভ করবে এতেই করবে, না করলে নাই। এই ৯ বছরে বয়ফ্রেন্ড স্বামী স্ত্রীর মতো আবার সবি করে গেল।’

‘ও আমাকে আর কি ভালোবাসল? কিসের বিয়ে করল? আমি শেষ পর্যন্ত চাইছি সব চুপ রেখে সমাধান করে অকে নিয়ে থাকতে। আমার শ্বশুর আর শাশুড়িকে বারবার বলছি- উনারা সমাধান করতে পারত! আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমার বউ ৯টা বছর যাকে ১০০% ভালবাসছি, ওকে প্ররোচনা দিছে মইন মিথি নামে দুই ফ্রেন্ড ওর মা-বাবা আমাকে মানসিক কষ্ট দিয়ে মারছে। আমিই এই বেইমানি মেনে নিতে পারি নাই। তারপর ও ভুলে আমি সুন্দর সংসার করতে চাইছি।’

শ্বশুরবাড়ির প্রতি ক্ষুব্ধ অভিমানী আকাশ আরও লেখেন-‘আমার শাশুড়ি-শ্বশুর আর বউ নামের কলঙ্ক করতে দিল না আমাকে প্রতি নিয়ত প্রেসার দিয়ে গেছে আমার বউ আমার মার নামে যা তা যা তা বলে গেছে। আমাকে ভালো না লাগলে ছেড়ে চলে যাইতে বলছি ১০০ বার। আমি বোকা ছিলাম তুমি সুখে থেক। অনেকে ওর ফ্যান বিলিভ করবে না আমি জানি, তবে এটাই সঠিক মরার আগে কেউ মিথ্যা বলে না আর বাইরে থেকে মানুষের ভিতরের চেহারা বুঝা যায় না।’

আকাশ আরেকটি স্ট্যাটাসে লেখেন-‘ও সুন্দরী, পড়াই ভালো, গান পারে সত্য; কিন্তু ও ভালো অভিনেত্রী ভালো চিটার। যাদের ইচ্ছা বিলিভ করবে, যাদের ইচ্ছা নাই করবে না। তবে কাউকে ভালোবেসে চিটার গিরি করো না।’

এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার দুই নম্বর সড়কের ২০ নম্বরে নিজ বাসা থেকে চিকিৎসক হৃদয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত নায়েক হামিদুল্লাহ জানান, সকাল ৬টার দিকে ডা. মোস্তফা মোরশেদকে হাসপাতালে আনলে সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ডা. মোস্তফা শরীরে ইনজেকশন পুশ করে আত্মহত্যা করেছেন। তার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে বলে জানান পুলিশের ওই কর্মকর্তা।

তবে স্বজনরা জানান, পারিবারিক বিষয়ে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার জের ধরে রাতে আকাশ অভিমানে শরীরে ইনজেকশন পুশ করে আত্মহত্যা করেছেন।