ওসি প্রদীপের নির্মম নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান দীর্ঘ ১১ মাস ৫ দিন পর কারামুক্ত হলেন।

সব মামলায় জামিন পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পান নির্যাতিত এই সাংবাদিক।

ফরিদুল মোস্তফার কারামুক্তির খবরটি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার জেলা কারাগারের সুপার মো. মোকাম্মেল হোসেন।

জানা গেছে, সংবাদ প্রকাশের জেরে টেকনাফের আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাসের রোষানলের শিকার হন কক্সবাজারের সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান। একের পর এক তার বিরুদ্ধে করা হয় ছয়টি মামলা। দীর্ঘ ১১ মাস কারাভোগ শেষে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন দৈনিক জনতার বাণীর সম্পাদক ফরিদুল মোস্তফা।

বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কক্সবাজার জেলা যুগ্ম দায়রা জজ ১ম আদালত তার জামিন দেন। এর আগে ৫টি মামলায় জামিন পান এই সাংবাদিক। এদিকে ফরিদুলের বিরুদ্ধে করা এসব মামলা পরিচালনা করাসহ নানা কারণে চরম কষ্টে দিন পার করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা।

এতদিন নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। এমনকি নানা জায়গায় প্রতিকার চেয়েও রেহাই পাননি বলে অভিযোগ ফরিদুলের পরিবারের লোকজনদের।

তাদের অভিযোগ, দৈনিক জনতার বাণী ও কক্সবাজার বাণীর অনলাইনে ‘টাকা না দিলে ক্রসফায়ার দেন টেকনাফের ওসি’ সংবাদ প্রকাশ করায় গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে ওসি প্রদীপের নিজস্ব বাহিনী দিয়ে ঢাকা থেকে ধরে আনে সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খানকে।

পরে টেকনাফ ও কক্সবাজারে এনে তার ওপর চালানো হয় লোমহর্ষক নির্যাতন। পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র, ইয়াবা, বিদেশি মদসহ ৬টি সাজানো মামলা দেয়া হয় তার বিরুদ্ধে। পরে আদালতে হাজির করলে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় ফরিদুলকে।

এদিকে সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফার ওপর যে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল সেই কথা নিজেই স্বীকার করেছেন বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

সম্প্রতি টেকনাফের আরেক সাংবাদকর্মী রহমত উল্লাহর সঙ্গে ওসি প্রদীপের একটি কথোপকথনের অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

অডিওতে শোনা যায়, ওসি প্রদীপ সাংবাদিক রহমত উল্লাহকে বলেন- আমার বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা লিখলে খবর আছে। এক পা আমার বাম পায়ের নিচে রেখে আরেক পা টেনে ছিঁড়ে ফেলমু। আমি জেল-ফাঁসি কিছুই মানি না। দেখেন না, ফরিদুল মোস্তফারে কী করেছি? উল্টাপাল্টা করলে ধরে এনে রান ফাইরা ফেলব।’

এর আগে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচ মামলায় জামিন পান ফরিদুল। সব শেষ যে মামলায় তার জামিন হয় এটি ছিল চাঁদাবাজির মামলা। গত বছরের ৬ জুলাই বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপের নির্দেশে টেকনাফ থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ফরিদুলের প্রধান আইনজীবী আবদুল মান্নান।

সিনিয়র আইনজীবী আবদুল মান্নান বলেন, সাংবাদিক ফরিদ টেকনাফ ও কক্সবাজারের মাদক ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততা নিয়ে সিরিজ সংবাদ প্রকাশ করেন। এর জের ধরে তাকে নিধন মিশনে নামেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

যেখানে পাবে সেখানেই ক্রসফায়ারের ঘোষণা দেয়া হয়। তাই প্রাণের ভয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার।

গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর মোবাইল ট্র্যাকিং করে রাজধানীর মিরপুর পল্লবী এলাকার ভাড়া বাসা থেকে আটক করে তাকে টেকনাফে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ওসি প্রদীপের হেফাজতে তিন দিন আটকে রেখে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়। পানির বদলে প্রস্রাব আর চোখে মরিচের গুঁড়া মেখে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তাক্ত করা হয়েছিল। হাত-পায়ের নখ প্লাস দিয়ে টেনে উঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, ফরিদুলের চোখ দুটো প্রায় অন্ধ করে অবৈধ অস্ত্র, ইয়াবা, বিদেশি মদ উদ্ধার দেখিয়ে ৩টি মামলা দেয়া হয়।

ওসি প্রদীপের দালাল হিসেবে পরিচিত মৌলভী মুফিজ ইকবাল, জহির আহমদ, আবুল কালামকে বাদী সাজিয়ে আরও ৩টি চাঁদাবাজিসহ মোট ৬টি সাজানো মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

ফরিদের স্ত্রী হাসিনা আক্তার জানিয়েছেন, গত বছর ২৬ জুন ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রকাশ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। পরে ওসি প্রদীপের ভয়ে কক্সবাজার সমিতিপাড়ার বাড়ি বিক্রি করে আমরা ঢাকায় মিরপুরে চলে যাই। কিছুদিন পর ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে আসে টেকনাফ থানায়। ওসি প্রদীপ নিজেই আমার স্বামী ফরিদুল মোস্তফাকে লোমহর্ষক নিপীড়ন করেছে। আমি (হাসিনা) তার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক বিচার চাই।