জাতীয় স্বদেশ | তারিখঃ নভেম্বর ৫, ২০১৯ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 1608 বার
দুর্নীতির অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের অপসারণ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১২টা থেকে সোয়া বারোটা পর্যন্ত উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থানরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ৮ শিক্ষকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এছাড়া দায়িত্ব পালন করার সময় চার সাংবাদিককেও মারধর করে আহত করেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। এদিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য হল ভ্যাকেন্ট করে বিকাল ৫টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন। বেলা ১২টায় এক জরুরি সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ।
ছাত্রলীগের হামলায় আহতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আটজনকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে বলে জানান জাবি চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. রেজওয়ানুর রহমান।
আহত শিক্ষকরা হলেন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস, মীর্জা তাসলিমা সুলতানা, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার হাসান মাহমুদ, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানাসহ আরও কয়েকজন।
মারধরে আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪৪তম আবর্তনের দর্শন বিভাগের মারুফ মোজাম্মেল, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মাহাথির মুহাম্মদ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাইমুম ইসলাম, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের রাকিবুল ইসলাম রনি, ৪৮তম আবর্তনের ইংরেজি বিভাগের আলিফ মাহমুদ, অর্থনীতি বিভাগের উল্লাস, দর্শন বিভাগের রুদ্রনীল, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সৌমিক বাগচীর নাম জানা গেছে।
এছাড়া ৪৪তম আবর্তনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ছাত্রী ছন্দা ও ৪৭তম আবর্তনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাউদা নামের দুই নারী শিক্ষার্থীকেও মারধর করতে দেখা গেছে।
সংবাদ সংগ্রহের সময় হামলায় আহত সাংবাদিকরা হলেন, প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, মাইদুল ইসলাম, বার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি আজাদ, বার্তাবাজারের প্রতিনিধি ইমরান হোসাইন হিমু, বাংলা লাইভ টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি আরিফুজ্জামান উজ্জল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে সোমবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করেছিল ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর।
মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১১টায় উপাচার্য সমর্থক শিক্ষক-কর্মকর্তারা উপাচার্যকে বাসা থেকে বের করে তার কার্যালয়ে নিয়ে যেতে আসেন।
এসময় উপাচার্য সমর্থক শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের সাথে উত্তপ্ত বাক-বিতন্ডা চলতে থাকে। এর মধ্যেই পৌনে ১২টার দিকে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানার নেতৃত্বে একটি মিছিল নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে আন্দোলনকারীদের এলোপাথারি মারধর করতে শুরু করে।
ছাত্রলীগ কর্মীরা এলোপাথারি শিক্ষার্থীদের লাথি-কিল-ঘুষি দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এসময় ছাত্রলীগ কর্মীদের একাধিক শিক্ষকসহ কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে চ্যাংদোলা করে দূরে নিয়ে ফেলতে দেখা যায়।
মারধরের সময় উপাচার্য সমর্থক শিক্ষক সোহেল আহমেদ, নাসির উদ্দিন, আতিকুর রহমান, আব্দুল মান্নান চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, মাহমুদুর রহমান জনিসহ কয়েকজনকে ‘ধর ধর’, ‘জবাই কর’ ও ‘মার মার’ বলে চিৎকার করতে দেখা গেছে।
হামলা চলাকালে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ছাত্রলীগের মারধরের বিষয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষক পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খবির উদ্দিন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এরকম ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। উপাচার্যপন্থী শিক্ষকদের উপস্থিতি ও প্রত্যক্ষ উস্কানিতে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ছাত্রলীগ যখন আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে তখন ভিসিপন্থী শিক্ষকরা তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে হাততালি দিয়েছে।”
আর হামলার বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, “আমরা শিবিরমুক্ত ক্যাম্পাস চাই। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল।”
তবে আন্দোলনে শিবির সম্পৃক্ততার ছাত্রলীগের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আন্দোলকারীদের মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন।
তিনি বলেন, “আন্দোলনে কোন শিবির সংশ্লিষ্টতা নেই। যেকোন শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য শিবির ব্লেইম দেওয়াটা পুরোনো অপকৌশল। বুয়েটের আবরারকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছে, এখানেও একইভাবে অভিযোগ তুলে হামলা চালানো হয়েছে। উপাচার্য অপসারণ আন্দোলনের সাথে যুক্ত এমন অনেকেই আজ ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছে যারা ক্যাম্পাসে বামপন্থী রাজনীতির চিহ্নিত মুখ। তাই তাদের এসব কথা তাদের দুর্নীতি ঢাকার অপকৌশল।”
হামলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) আ.স.ম. ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, “ঘটনাস্থলে মব তৈরি হয়েছিল। চেষ্টা করেও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। বড় ঘটনা এড়াতে আমরা তৎপর আছি।”
মারধরের ঘটনার আধাঘন্টা পরে উপাচার্য তার সমর্থক শিক্ষকদের সাথে নিয়ে তার কার্যালয়ে যান।
পরে সেখানে তিনি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন,“আমার সহকর্মী ও ছাত্রলীগ কর্মীদের এ গণ অভ্যূত্থানের জন্য ধন্যবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন খুলে দেয়া হয়েছে। এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাভাবিক গতিতে চলবে।”
কেআই/এসি
Leave a Reply