একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে সরকার গঠনের সুযোগ পেলে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে ভবিষ্যত্মুখী এক নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা হবে। এর জন্য নতুন এক সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছতে একটি জাতীয় কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিএনপি। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারে দলটি এই প্রতিশ্রুতি দেয়। ভোটেরদিন যে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, ক্ষমতায় গেলে তা নিত্যদিনের অনুশীলনে পরিণত করারও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঐক্যের সরকার গঠন করে ঐকমত্য, সকলের অন্তর্ভুক্তি ও প্রতিহিংসাহীনতা— এই মূলনীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার কথাও বলেছে বিএনপি।

বিএনপির ইশতেহারে উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে— নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো প্রবর্তন, রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা সুদৃঢ় করা, গণভোট পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট ও বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল; চলমান কোনো প্রকল্প বন্ধ না করে মেগা প্রকল্পের ব্যয়ের আড়ালে সংঘটিত দুর্নীতি নিরীক্ষা করে দেখা, বেকার ভাতা চালু এবং পাঁচ বছরে এক কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। এছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন, সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন, ন্যায়পাল নিয়োগ, র্যাবের পুনর্গঠন, পুলিশ ও আনসার ছাড়া শর্ত সাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা উঠিয়ে দেওয়া, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর যাতায়াতের সময় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ রোধে ব্যবস্থা নেওয়ারও অঙ্গীকার করেছে বিএনপি।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে থাকা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার বিধানের অঙ্গীকার করেছে বিএনপিও। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব প্রতিবছর প্রকাশ করার কথাও বলা হয়েছে বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে। তবে ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে ক্ষমতায় যেতে পারলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখার কথা বলা হলেও এ ব্যাপারে বিএনপির ইশতেহারে কিছু বলা হয়নি।

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘সম্মান’ ও ‘মর্যাদা’ প্রতিষ্ঠা এবং বিএনপির ঘরছাড়া নেতা-কর্মীদের ঘরে ফেরার সুযোগ দিতে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে ভোট চেয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ইশতেহার ঘোষণা করে দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের একটি ভোট আমাদের নেত্রীর জীবনকে পুনরায় আলোয় উদ্ভাসিত করবে।

বিএনপির ইশতেহারের উল্লেখযোগ্য অন্যান্য প্রতিশ্রুতি

বিএনপির ইশতেহারে বলা হয়, সরকার গঠনের সুযোগ পেলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে শর্ত সাপেক্ষে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়া হবে। র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। র্যাবের বর্তমান কাঠামো পরিবর্তন করে অতিরিক্ত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন গঠন করা হবে, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে। পুলিশ বাহিনীর ঝুঁকিভাতা বাড়ানো হবে। পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পুলিশের জন্য কল্যাণমূলক প্রকল্প গৃহীত হবে। ইন্সপেক্টর ও সাব ইন্সপেক্টরদের বেতন ছয় মাসের মধ্যে আপগ্রেড করা হবে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা অবসরে গেলেও তাদের রেশনিং সুবিধা দেওয়া হবে।

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করার কথা বলেছে বিএনপি। ইশতেহারে বর্তমান বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য একটি জুডিসিয়াল কমিশন গঠন; দেশরক্ষা, পুলিশ ও আনসার ব্যতীত শর্তসাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা না রাখা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি সংক্রান্ত সকল অনুসন্ধান রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ এবং একইসঙ্গে এ সবের অধিকতর তদন্তের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ১১ শতাংশে উন্নীত করা; সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডে যোগ্য, সত্, দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহ পরিচালনা ও তদারকির ভার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করার, দেশে কর্মরত বিদেশিদের ওয়ার্ক পারমিটের আওতায় এনে মুদ্রাপাচার রোধ করা; বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম-খুন এবং অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানোর অঙ্গীকার করেছে বিএনপি।

ইশতেহারে এক বছরব্যাপী অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত যেটাই আগে হবে শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা চালু করে তাদের যৌক্তিক অর্থনৈতিক উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার, ২৫ বছর পর্যন্ত তরুণদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ইয়ুথ পার্লামেন্ট গঠন, সকল মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে ঘোষণা, মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের নামে দুর্নীতির অবসান ঘটানো, মূল্যস্ফীতির নিরিখে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ভাতা বাড়ানো, দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করে সেসব স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি সঠিক তালিকা প্রণয়ন এবং তাদের যথাযথ মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে।

বিএনপির ইশতেহারে বলা হয়— কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্রজেক্টের উচ্চব্যয়ের কারণ তদন্ত করে দেখা হবে। দুস্থ, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারী ও অসহায় বয়স্কদের ভাতার পরিমাণ মূল্যস্ফীতির নিরিখে বৃদ্ধি, বেসরকারি ও স্বনিয়োজিত খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য বার্ধক্যের দুর্দশা লাগবের উদ্দেশে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে একটি পেনশন ফান্ড গঠন এবং গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হবে।

ইশতেহার প্রকাশের অনুষ্ঠানে মূলমঞ্চে বিএনপি মহাসচিব ছাড়াও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বিএনপিপন্থি পেশাজীবী নেতা অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ, মাহবুব উল্লাহ, আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী, আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, সদরুল আমিন, আখতার হোসেন খান, ফিরোজা হোসেন, অধ্যাপিকা দিলারা চৌধুরী, অধ্যাপক খলিলুর রহমান, আবদুল লতিফ মাসুম, আবদুল মান্নান মিয়া, সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।