বিদেশ | তারিখঃ নভেম্বর ২৬, ২০১৮ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 596 বার
কলহ, মনোমালিন্য ও পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধা, শীতলতা—গত ৪৬ বছর এসব অনুভূতি নিয়েই সংসার করে গেছে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ভালোবাসাহীন ওই দাম্পত্যের অবসান ঘটল গতকাল রবিবার। ইইউ ও ব্রিটেনের সম্পর্ক ও সম্পর্কের সমাপ্তিকে অনেকটা এভাবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা।
প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকালীন ব্রিটিশ ইতিহাসবিষয়ক অধ্যাপক পলিন স্ন্যাপার বলেন, ১৯৭৩ সাল থেকেই এটি ছিল সুবিধাবাদী সম্পর্ক। বরাবরই এর অর্থনৈতিক মাত্রা যতটা তীব্র ছিল, রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল ততটাই ম্রিয়মাণ। আবেগ সম্পর্কিত সম্পর্ক প্রায় ছিল না বললেই চলে।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়াল তখন থেকেই ব্রিটেন এর বিরোধী। কিংস কলেজ লন্ডনের ইউরোপীয় রাজনীতিবিষয়ক অধ্যাপক আনন্দ মেনন বলেন, ‘আমরা এতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিলাম না যে যোগ দিতে হবে।’ বরং এর পরিবর্তে ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের বিশেষ সম্পর্কের ওপর আরো আলো ফেলতে চেয়েছিল। পাশাপাশি নিজেদের সাম্রাজ্যের প্রতিও আরো মনোযোগী হতে চেয়েছিল তারা। লন্ডন কখনোই ইউরোপ মহাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে চায়নি। তাদের যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল ১৯৪৬ সালে জুরিখে দেওয়া এক ভাষণে ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব ইউরোপ’ গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।
১৯৬০ সালে ব্রিটেনের অবস্থানে পরিবর্তন আসে। অর্থনৈতিকভাবে ফ্রান্স ও জার্মানির চেয়ে পিছিয়ে পড়ে তারা। সে সময় ইউরোপের একক বাজার তাদের জন্য পরিত্রাণের উপায় হিসেবে দরজায় এসে দাঁড়ায়। সে সময় তারা ইউরোপে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও কাজটি সহজ ছিল না। ফ্রান্স পর পর দুই দফা ইউরোপে তাদের ঢোকার আবেদনে ভেটো দেয়। ১৯৬১ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আস্তাবলের ঘোড়া হচ্ছে ব্রিটেন। তাদের পক্ষে ইউরোপের স্পিরিট বোঝা সম্ভব নয়। ১৯৬৭ সালে আবারও ভেটো দেয় ফ্রান্স।
ইউরোপের অর্থনৈতিক জোন ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটিতে (ইইসি) ব্রিটেন প্রবেশ করে ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি। এর দুই বছরের মাথায় আয়োজিত এক গণভোটে ব্রিটিশরা ইইসিতে থেকে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করে। ৬৭ শতাংশ ব্রিটিশ এর পক্ষে ভোট দেয়। তবে ১৯৭৯ সালে ইউরোপের একক মুদ্রাব্যবস্থায় প্রবেশে অস্বীকৃতি জানায় ব্রিটেন। সমালোচকদের মতে, ওই সময় ব্রিটেনের অবস্থা ছিল ইইউয়ের ‘এক পা ভেতরে, এক পা বাইরে’র মতো। ১৯৮৫ সালে শেনজেন চুক্তিতেও সই করেনি তারা। ব্রিটেন চূড়ান্তভাবে ইউরোতে যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে।
ব্রিটেন শুরু থেকেই অনিচ্ছা নিয়ে ইইউয়ের সঙ্গে জুড়ে ছিল। এর মধ্যে ঘটতে থাকে ইউরো জোন সংকট, ইউরোপ থেকে ব্রিটেনের দিকে অভিবাসনের ক্রমবর্ধমান চাপ, ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আসা সস্তা শ্রমিক, যা ব্রিটিশদের কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করছিল—সব মিলিয়ে ২০১৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন নির্বাচন ডাকতে বাধ্য হন। ব্রেক্সিটপন্থীরা ইইউ ছাড়ার পক্ষে মত দেন। তাঁদের ভাষ্য ছিল, সীমান্ত, আইন আর অর্থনীতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আবারও তাঁদের হাতেই ফেরত যাচ্ছে। সেই নির্বাচনে নেতিবাচক রায়ের হাত ধরেই গতকাল হয়ে গেল চূড়ান্ত বিচ্ছেদ। কার্যকর হওয়ার সময়টিও খুব দূরে নয়, ২৯ মার্চ, ২০১৯। রবার্ট স্কুম্যান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পাসকেল জোয়ানিন বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের থাকার সময় তারা স্বপ্নের মতো এক পরিস্থিতির মধ্যে বাস করত। এখন বহু কিছুই তাদের ছাড়তে হবে।’ ব্রেক্সিটের এই অংশটি তারা হয়তো আগে ভেবে দেখেনি।
সূত্র : এএফপি।
Leave a Reply