পাহাড় ও জলের জনপদ জুরাছড়ি। জুরাছড়ির দুর্গম পাহাড়ে খুঁজে পাওয়া যায় বুনোগন্ধ আর নীরবতা। দেশের বৃহত্তম এই জেলার চারপাশে ছড়িয়ে আছে ১০টি উপজেলা। রাঙামাটির সদর থেকে ৫৭ কিলোমিটার দূরের পথ স্থানীয়ভাষায় যার নাম জুরাছড়ি। ‘জুর’ শব্দের অর্থ ঠান্ডা আর ‘ছড়ি’ শব্দের অর্থ ছড়া বা ঝরণা। জুরাছড়ি নামের ঝরনা থেকে এই উপজেলার নামকরণ হয়েছে।
বিস্তীর্ণ এইজুরাছড়ি উপজেলার পূর্বে ভারতের মিজোরাম, উত্তরে বরকল, দক্ষিণে বিলাইছড়ি এবং পশ্চিমে রাঙামাটি। তবে এখানকার একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম নৌপথ।
ভোরের আলোয় হেমন্তের ফুরফুরে বাতাস আর মিষ্টি রোদ মাথায় নিয়ে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে মোটর বাইকে জুরাছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দীঘিনালা থেকে লংগদু পৌঁছতে সময় লাগে এক ঘণ্টার বেশি। সড়ক পথে ৩৮ কিলোমিটারে সর্পিল পথ পেরিয়ে লংগদু পৌঁছে দেখি ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাড়ে ৮টা বাজে। সকাল ১০টায় লংগদু থেকে লঞ্চে রওনা হলাম শুভলং-এর পথে। লঞ্চের ছাদেই নিজেদের জন্য জায়গা করে নিলাম। দোতলা লঞ্চের ছাদে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে এগিয়ে চলেছি। জেলা রাঙামাটির সঙ্গে উপজেলাগুলোর যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই দোতলা লঞ্চগুলো।
কাপ্তাই লেকে বিপুল জলরাশি। লেকে পানকৌড়ি, সারস, বালি হাঁসসহ অসংখ্য পাখির ঝাঁক ঠেলে লঞ্চ চলছে কাট্টলি বিলের দিকে। আশপাশে ভাসান্যাদাম, গুলশাখালী পেরিয়ে দ্বীপ গ্রাম কাট্টলি বিলে এসে ১০ মিনিটের যাত্রা বিরতি দেওয়া হলো। মাছ ধরার মৌসুমে লেক জুড়ে ছোট ছোট নৌকায় চড়ে জাল ফেলছে জেলেরা। বিশাল জলরাশির বুকে ছোট ডিঙি নৌকা ভেসে চলেছে। গ্রামের বাসিন্দারাও নৌকায় যাতায়াত করে। জলবেষ্টিত হওয়ায় প্রায় প্রত্যেক পরিবারই নিজস্ব নৌকা ব্যবহার করে থাকেন।
দুপুর নাগাদ পৌঁছাই শুভলং-এ। দুপুরের খাওয়া সেরে অপেক্ষা করছিলাম জুরাছড়ির শেষ লঞ্চের জন্য। শুভলং-এর উঁচু পাহাড় ছাপিয়ে সাদা মেঘের আনাগোনা। শীতের শেষে সবুজ পাহাড় অনেকটা ধূসর এখন। প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর জুরাছড়ির লঞ্চ এল। লঞ্চ করে রওনা হলাম জুরাছড়ির পথে।
লঞ্চের অধিকাংশ যাত্রীই স্থানীয়। জুরাছড়িতে হাতেগোনা কয়েক ডজন ব্যবসায়ী আর সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া বাইরের মানুষের তেমন চলাচল নেই । লঞ্চে উঠতেই স্বাগত জানাল লঞ্চের সারেং মনসুর। দীর্ঘদিন ধরে এ পথে লঞ্চ চালান তিনি।
কিছুটা পথ পেরোতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আদিবাসীদের ছোট ছোট ঘর, লেক পাড়ের পাহাড়জুড়ে জুমের আবাদ, তরমুজের ক্ষেত।ছোট পাহাড় আর দ্বীপে মোড়ানো কিছুটা পথ যেতেই আলাদা হয়ে যায় বরকল আর জুরাছড়ির পথ। বাঁক নিতেই সবুজ পাহাড় যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। জুরাছড়ি’র দিকে লঞ্চ ঢুকতেই চোখে পড়ল এক ঝাঁক সারসের দল। বাচ্চাসহ বিচরণ করছে সারস পাখির বড় দলটি। লেকের নিচে জমিগুলো ভেসে উঠেছে। জমিতে ধানের আবাদ করছে আদিবাসী চাষীরা। লঞ্চে যাওয়ার পথে কথা হয় কয়েকজন আদিবাসীর সঙ্গে। তারা জানাল জুরাছড়িতে থাকার মতো কোনও গেস্ট হাউস এমনকি কাঠের বোর্ডিংও নেই। রাতে থাকার ব্যবস্থা নিয়ে কথা হচ্ছিল মনসুরের সঙ্গেও। পরে জুরাছড়ি বাজারে গিয়ে খাবার দোকানের মালিক আলী ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। রাতে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি। রাতে কোথায় থাকব সে বিষয় কোনও ধরনের দুশ্চিন্তা না নিয়েই চলছে আনন্দের পথচলা। যাত্রীদের ওঠা নামার জন্য লঞ্চ থামছে বিভিন্ন ঘাটে।
পুরো আকাশ যেন নেমে এসেছে লেকের পানিতে। জলের বাগান দেখলাম এই প্রথম। লেকের স্বচ্ছ পানির নিচে সবুজের এক ভিন্ন জগৎ। পানির নিচে বড় বড় শ্যাওলার বন ।
সন্ধ্যার আগেই পৌঁছাই জুরাছড়ির ঘাটে। মোটরবাইকে করে রওনা হই বাজারের দিকে। পথের দু’পাশে আদিবাসীদের ঘর, প্রাচীন বৃক্ষ আর সবুজের সমারোহ। দূরে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পবর্তমালা। উপজেলার পাশেই আলী ভাইয়ের ৩৪ বছরের পুরোনো খাবারের দোকান। আমাদের দেখেই স্বাগত জানালেন তিনি। চট্টগ্রামের বাসিন্দা আলী ভাই, তিনি আশ্বাস দিলেন রাতে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। হোটেলে ব্যাগ রেখে বের হলাম আশপাশটা ঘুরে দেখব বলে। সঙ্গী হলেন হেমন্ত চাকমা।
হ্রদ আর পাহাড় বেষ্টিত জুরাছড়ির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে যে কেউ। এমন দুর্গম প্রান্তিক পাহাড়ে সবসময় খুঁজে পাওয়া যায় বুনোগন্ধ আর নীরবতা। জুরাছড়িতে ঝুপ করে রাত নেমে এসেছে। জুরাছড়ির রাতের সৌন্দর্য্য ছিল রূপকথার গল্পের মতো। পাহাড় ঘেরা দূরের এক জনপথকে যেন ঝাপটে ধরেছে একদল নক্ষত্র। পুরো রাজ্যজুড়ে নেমে এসেছে জ্যোৎস্নার দল। খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে দেখলাম চাষী আর জেলেরা নিজেদের নৌকায় করে রওনা হচ্ছেন গন্তব্যে। এখানে মেয়েরাও নৌকা চালাতে পারদর্শী।
এবার ফেরার পালা। সকালের লঞ্চ করে আবার রওনা হলাম রাঙামাটির পথে। ফেরার পথে মনে হচ্ছিল, দুর্গমতা কিভাবে ঢেকে রাখে তার প্রকৃতির গোপন সৌর্ন্দয্য! এ যেন পাহাড়ের ডানায় চড়ে বসা এক অন্য জনপথ।-দৈনিক আজাদি