অর্থনীতি | তারিখঃ সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৮ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 939 বার
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাকের বড় সমস্যার নাম- ব্র্যান্ড ইমেজ। নিরাপত্তাহীন কর্মপরিবেশ এবং কম দামি পোশাকের রফতানিকারক দেশ হিসেবে দুর্নামও রয়েছে এখনও। এটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি পুরোপুরি। বিদেশি ক্রেতা এবং ব্র্যান্ড প্রতিনিধিদের সঙ্গে পোশাকের দর নিয়ে দর কষাকষিতে ‘আন্ডারডগ’ অর্থাৎ জেতার সম্ভাবনা নেই- এ অবস্থান মেনে নিয়েই আলোচনা শেষ করেন উদ্যোক্তারা। এ রকম কারণেই ভোক্তাপর্যায়ে বিক্রি হওয়া ৩৫ ডলারের পোশাক বাংলাদেশ থেকে খুব সহজেই নেওয়া যায় ৫ ডলারে।
এ অবস্থা মেনে নেননি একজন। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেডের ছোট-মাঝারি মানের ডেনিম এক্সপার্ট কারখানার নবীন মালিক মোস্তাফিজ উদ্দিন। যে কোনো মানের এক পিসের ডেনিম ২০ ডলারের নিচে ছাড়েন না তিনি, যা সাধারণ একটি ডেনিমের মোট মূল্যেরও বেশি।
মোস্তাফিজের মতো কিছু উদ্যোক্তার সাফল্যের হাত ধরে ২৮ জাতির জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ডেনিম রফতানিতে বাংলাদেশ এখন এক নম্বর। বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমেই পোক্ত হচ্ছে অবস্থান। মোস্তাফিজ মনে করেন, ডেনিমের ওয়াশিং-ফিনিশিংয়ে যে ক্যারিশমা সেটা আয়ত্ত করা এবং কাঁচামাল উৎপাদন বাড়াতে পারলে বিশ্বের ছোট-বড় সব বাজার দখলে নেবে বাংলাদেশের ডেনিম।
‘কম দামের বাজার বাস্তবতার বিপরীতে আপনার বাড়তি দরের রহস্য কী?’ সোজাসাপ্টা জবাব মোস্তাফিজ উদ্দিনের, ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু।’ ডেনিম নিয়ে কাজ করেন এ রকম ক্রেতারা বাংলাদেশের ডেনিম এক্সপার্টের আদ্যোপান্ত জানেন। অনেক ক্রেতাই রফতানি আদেশ দিতে চান। কিন্তু মানের সঙ্গে আপস নেই বলে একসঙ্গে অনেক কাজ করা যায় না। কম কাজ বেশি লাভ- এ মূলমন্ত্রে কর্মীদের সঙ্গে উৎপাদনে নেমে পড়েন মোস্তাফিজ।
‘ব্র্যান্ড ভ্যালু কেমনে এলো?’
মোস্তাফিজ জানালেন, ডেনিমকে ঘিরেই তার ধ্যান-দুনিয়া। দেশে কিংবা বিদেশ-বিভুঁইয়ে নানান কিসিমের ডেনিমের সঙ্গেই কাটে তার পুরোটা সময়। দুনিয়ার কোথায় কোন ডেনিমের হাল ফ্যাশনের কী হাল- মাথায় দিনমান সেই আকুলি-বিকুলি। বিশ্বের যেখানেই ডেনিমের কোনো আয়োজন, সেখানেই সশরীরে উপস্থিতি। ফেরি করে বেড়ান বাংলাদেশের ডেনিমের বন্দনা। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটসহ প্রায় সব কূটনীতিক, দুনিয়ার বিখ্যাত ব্র্যান্ড প্রতিনিধিরা তার ডেনিম স্টুডিও দেখেছেন সরেজমিন। বলতে গেলে সংশ্নিষ্টরা তার ডেনিম গবেষণার খবর জানেন এখন।
বাংলাদেশের পোশাক রফতানি মানেই দর্জিগিরি- এ দুর্নাম দূর করে ব্র্যান্ডিংয়ে বাংলাদেশের হাতেখড়ি হয়েছে মোস্তফিজের হাতেই। গড়ে তুলেছেন ডেনিমের ব্র্যান্ড- ‘ব্লুএক্সঅনলি’। যা বিদেশে বাংলাদেশের পোশাকের একমাত্র ব্র্যান্ড। নেদারল্যান্ডসের আমস্টাডামে নিজস্ব গুদাম ঘর। শোরুম থেকে ফ্যাশন-দুরস্ত ডেনিম পণ্য এখন দ্যুতি ছড়াতে শুরু করেছে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। জারা, ডিজেল কিংবা ওয়ালমার্টের মতো ব্র্যান্ডিং দুনিয়ায় একদিন সমীহ কুড়াবে বাংলাদেশের ব্লুএক্সঅনলি- বড় এ স্বপ্নেই কর্ণফুলী ইপিজেডের ছোট্ট ডেনিম স্টুডিওতে চলে ক্যারিক্যাচার। ডিজাইন থেকে ফিনিশড প্রোডাক্ট নিজেই তদারক করেন। মনমতো না হলে নিজেই হাতে তুলে নেন ভারী আয়রন। সঙ্গে আছে অনুগত বিশাল এক কর্মীবাহিনী।
‘কীভাবে ধ্যানে এলো এই ডেনিম ধারণ?’
মোস্তাফিজ উদ্দিন জানালেন, জীবনে পোড়খাওয়া অনেক অভিজ্ঞতায় এক রকম মনের কাঁচা জেদকে পুঁজি করেই ১৯৯৯ সালে গড়ে তুলেছেন ডেনিম এক্সপার্ট কারখানা। সঙ্গে দুই ভাই। ব্লুএক্সঅনলির ডেনিম এখান থেকেই উৎপাদন হয়। বিদেশি দামি ব্র্যান্ডের জন্যও ডেনিম উৎপাদন হয় এখানে। গত ৫ বছর ধরে ঢাকায় বছরে দু’বার ডেনিমের প্রদর্শনী ‘ডেনিম এক্সপো’ আয়োজন করছেন নিয়মিত। উদ্দেশ্য, গুণগত মানের বাংলাদেশের ডেনিমে বিশ্বক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ। তার দাবি, ‘ডেনিমের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর মধ্যে বাংলাদেশের এ প্রদর্শনী এখন দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ। এ প্রদর্শনীতে আসতে দেশ-বিদেশের অনেকই লাইন ধরেন। আমি সবাইকে নেই না। ডেনিমে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঢুকতে দেই না।’
ডেনিম নিয়ে পাগলামির অনেক খেসারত দিতে হয়েছে মোস্তাফিজ উদ্দিনকে। তবে সুনামও কম কুড়াননি। গত মে মাসে ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ফ্যাশন সম্মেলনে এশিয়ার একমাত্র মনোনীত প্রতিনিধির সম্মান পেয়েছেন তিনি। ওই সম্মেলনে ইউরোপিয়ান কমিশনের (ইসি) প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্কসহ বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারক, ব্র্যান্ড প্রতিনিধি ও কয়েকটি দেশের উদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন। তার বক্তৃতার পর ইসি প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের পোশাক খাতের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। ডেনিস রানীর বিশেষ ডিনারেও আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে যোগ দেন তিনি। তার প্রতিষ্ঠান ডেনিম এক্সপার্ট পোশাক ও পাদুকা শিল্পের স্যোসাল কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেশনের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ডব্লিউআরএপি এবং কারখানায় নৈতিক ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার সনদ এসইডিইএক্সসহ মোট ৫টি আন্তর্জাতিক সনদ পেয়েছে।
বাংলাদেশের ডেনিমের ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মোস্তাফিজ উদ্দিন জানান, দীর্ঘদিন ধরে পোশাক উৎপাদন করলেও একাগ্রতার অভাবে বাংলাদেশের পোশাকের নিজস্ব ব্র্যান্ডিং হয়নি। রফতানি আদেশ কাজ করার ক্ষেত্রেও মৌলিক মানের পোশাক থেকে বেরিয়ে আসা যায়নি। এ কারণে উৎপাদন বেশি হলেও সে হারে অর্থ আসছে না দেশে। তবে দিন বদলাতে শুরু করেছে। নতুন প্রজন্মের অনেক উদ্যোক্তাই দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে পোশাক খাতে যুক্ত হচ্ছেন। ইইউর মতো যুক্তরাষ্ট্রেও ডেনিমের বাজার বাড়ছে। তবে বাংলাদেশে ডেনিম রফতানি এখনও ৪০০ কোটি ডলারের ঘরে। অথচ ডেনিমের বাজার হচ্ছে এখন ৬ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। ডেনিম নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ২০২০ সালে বাজার দাঁড়াবে ৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে। তার মানে ডেনিমের বিশাল বাজার বাংলাদেশের সামনে।
Leave a Reply