মধুচক্রের ফাঁদ গড়ে তুলেছেন সাত পুরুষ ও তিন নারী । চক্রের হোতা বিলকিস বেগম। টার্গেট করা হয় ব্যবসায়ী পুরুষ বা চাকরিজীবীদের। নারীদের নামে একাধিক ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে সাইবার দুনিয়ায় তাঁদের বিচরণ। নানাজনের ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে টার্গেটের সন্ধান মিললে পাঠানো হয় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। বন্ধু তালিকায় প্রবেশের পরই শুরু হয় মেসেঞ্জারে কথোপকথন। ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। এর পরই কৌশলে ‘আস্তানায়’ ডেকে নিয়ে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অংকের টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চক্রটি ২০১৭ সাল থেকে সক্রিয়। ১০ সদস্যের চক্রে আছেন- বিলকিস বেগম, আয়শা খাতুন আফরিন, আঁখি বৈরাগি জেরিন, রাজু শেখ, রাজু ফকির, কামরুল মিয়া, হাসান শেখ, লালন মোড়ল, বখতিয়ার মিয়া ও আসাদ মিয়া। গুলশান থানার এক মামলায় এ চক্রের বখতিয়ার ও আসাদ ছাড়া বাকি আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। তাঁদের মধ্যে জেরিন ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, চক্রটি রাজধানীর উত্তরখানে তিনটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডের ‘আস্তানা’ গড়ে তুলেছে। কয়েকটি ধাপে কাজ করেন তাঁরা। নারী সদস্যদের কাজ হলো টার্গেট ব্যক্তিকে যে কোনো উপায়ে আস্তানায় নিয়ে আসা। পুরুষ সদস্যরা ভুয়া ডিবি বা পুলিশ পরিচয়ে বাসায় প্রবেশ করেন। তাঁদের এক তরুণী সদস্যের সঙ্গে ভুক্তভোগীকে বিবস্ত্র করে মোবাইল ফোনে ছবি ও ভিডিও করা হয়। এর পর ওই ছবি স্ত্রী কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠানো বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করে চক্রটি। তিন লাখ থেকে শুরু করে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করা হয়। মান-সম্মানের ভয়ে মোবাইল ব্যাংকিংসহ নানাভাবে টাকা পরিশোধ করেন ভুক্তভোগী। এর পরই আস্তানা থেকে মুক্তি মেলে।
ঢাকার বাইরেও সক্রিয় রয়েছে চক্রটি। গত ডিসেম্বরে এক মাসে রাজধানীতে চারজনকে এবং খুলনায় একজনকে ফাঁদে ফেলে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় তারা।

মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মহিউদ্দিন। ডিসেম্বরের শুরুতে ‘নুসরাত জাহান’ নামে একটি আইডি থেকে তাঁর ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। তিনি তা গ্রহণ করেন। নিজেকে তরুণী পোশাক ব্যবসায়ী পরিচয়ে কথোপকথন শুরু করেন মহিউদ্দিনের সঙ্গে। কয়েক দিনের মধ্যেই ঘনিষ্ঠতা হয়। নুসরাতের আসল নাম আঁখি বৈরাগি জেরিন।

৩০ ডিসেম্বর বিকেলে মহিউদ্দিনকে উত্তরখানের বাসায় যেতে বলেন জেরিন। কথামতো তিনি উত্তরখান রেলগেটে যান।

সেখান থেকে নুসরাত পরিচয় দেওয়া জেরিন ও আফরিন রেলগেট থেকে তাঁকে বাসায় নিয়ে যান। বাসায় প্রবেশের কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঁচ পুরুষ ঢোকেন সেখানে। অনৈতিক কাজের জন্য তিনি সেখানে গেছেন- এ অভিযোগে তাঁরা তাঁকে মারধর শুরু করেন। বিবস্ত্র করে মোবাইল ফোনে ছবি ও ভিডিও ধারণ করা হয়। পরে সেগুলো তাঁর স্ত্রী ও স্বজনদের কাছে পাঠানো এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করা হয়। বাধ্য হয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তিনি টাকা পরিশোধ করে মুক্তি পান।

এ ঘটনার এক সপ্তাহ আগে উত্তরখানের আরেকটি বাসায় ডেকে নিয়ে রউফ আহমেদ নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একই কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় ফেসবুকে যোগাযোগ হয় চক্রের সদস্য আফরিনের সঙ্গে। ২৩ ডিসেম্বর আফরিন ও চক্রের আরেক তরুণী জেরিন ব্যবসায়ীকে গুলশান থেকে উত্তরখানের বাসায় নিয়ে যান। তিনি চক্রটিকে ১২ লাখ ৩৩ হাজার ৭০০ টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন।

সিটিটিসি সাইবার বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, মধুচক্রের ফাঁদে ফেলে চক্রের সদস্যরা টাকা হাতিয়ে আসছে ২০১৭ সাল থেকে। তাদের প্রতারণা শুরু হয় টার্গেট ব্যক্তির ফেসবুক আইডিতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর মধ্য দিয়ে। পলাতক দুই সদস্যকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সূত্র-সমকাল