অতিবর্ষণের কারণে সৃষ্ট বানের পানি হামলে পড়ছে রাজধানীর চারদিকে। ফুলে-ফেঁপে উঠছে চারপাশের নদ-নদী। দিন যত যাচ্ছে, বিপদসীমার ওপরে পানি ওঠা নদীর সংখ্যা বাড়ছে। ইতোমধ্যে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কিছু এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা ধারণা করছেন।
পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন যে বন্যা, সেটা পানি নামার কারণে। নিম্নাঞ্চলে পানি নামছে, তাই প্লাবিত হচ্ছে। গত কয়েক দিনে সারাদেশে বৃষ্টি হওয়ায় প্রায় সব নদীতে পানি বেড়েছে। আগামী এক সপ্তাহ এ অবস্থা থাকবে। যেসব পথে পানি বের হওয়ার কথা, তা বালু দিয়ে ভরাট করে জবরদখল করা হয়েছে। সুতরাং পানি বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ হওয়ায় রাজধানীর পানি বের হতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, মূলত পূর্বাঞ্চল দিয়ে পানি ঢুকছে রাজধানীতে। শীতলক্ষ্যা নদী ও বালু নদের পানি প্রবেশ করছে। ইতোমধ্যে নন্দীপাড়া, জুরাইন, বাড্ডা, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জের কিছু অংশ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তিনি জানান, আগামী এক সপ্তাহ পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। এরপর পানি নেমে যাবে। তবে ১৯৮৮ সালের মতো ভয়াবহ বন্যা এবার হবে না বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সূত্রে জানা গেছে, কুশিয়ারা ব্যতীত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ধরলা, তিস্তাসহ আপার মেঘনা অববাহিকার নদীসমূহের পানি কমছে না। উল্টো আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরো বাড়তে পারে। নীলফামারী, লালমনিরহাটসহ উত্তরের জেলাগুলোতেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হবে। তবে কিছুটা আশার খবর হলো, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানি কমতে শুরু করেছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া আরো জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর ও নওগাঁর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। অন্যদিকে ঢাকার আশপাশের জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তিনি বলেন, পর্যবেক্ষণে থাকা ১০১টি পানির স্টেশনের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৭টির পানি বেড়েছে, ৪৯টির কমেছে। ৫টির পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। বিপদসীমার ওপরে নদীর সংখ্যা ১৭। বিপদসীমার ওপরে স্টেশনের সংখ্যা ২৭।
এছাড়া বন্যা দুর্গত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ডুবে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ক্ষেতের ফসল। পুকুর ও মাছের ঘের ভেসে গেছে। সবকিছু হারিয়ে চাষিরা চরম হতাশ হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। ভাঙন ও বন্যায় সবকিছু হারিয়ে বাঁধ বা আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ। সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে দিন যাচ্ছে বানভাসি মানুষের। অভিযোগ রয়েছে পর্যাপ্ত ত্রাণ না পাওয়ারও। তবে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সহায়তা হিসেবে পর্যাপ্ত চাল, নগদ টাকা ও অন্যান্য খাবার বরাদ্দ দিয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা : রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোকে ডুবিয়ে ১৬ বছর পর বন্যার পানি প্রবেশ করল। এরই মধ্যে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কিছু এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ডেমরার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের নলছাটা, দুর্গাপুর, তাম্বুরাবাদ, ধিৎপুর, খলাপাড়া, ঠুলঠুলিয়া, আমুলিয়া-মেন্দিপুর এলাকার নিম্নাঞ্চল বালু নদের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। খিলগাঁওয়ের ডিএসসিসির ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোর মধ্যে ইদারকান্দি, ফকিরখালী, দাসেরকান্দি ও গজাইরাপাড়ার রাস্তাঘাট ও নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে গেছে। ওয়ার্ডের নিম্নাঞ্চলের কমপক্ষে তিন কি. মি. রাস্তা তলিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও কোমর পানি জমেছে। এ ছাড়া ওয়ার্ডের ত্রিমোহনী, লায়নহাটি, নাগদারপাড়, নাসিরাবাদসহ বেশির ভাগ এলাকার নিম্নাঞ্চল ও বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের দেড় শতাধিক ঘরে প্রবেশ করেছে বানের পানি।
এলাকাবাসী জানায়, ডিএসসিসির ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণগাঁও, ভাইগদিয়া ও মানিকদিয়া খালের তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। এদিকে ডিএসসিসির ৭১ নম্বর ওয়ার্ডের মান্ডা, কদমতলী, ঝিলপাড়া ও উত্তর মান্ডা এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ খালের মাধ্যমে বালু নদের পানি ওই এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। আর খালতীরবর্তী বেশির ভাগ বাড়িতেই পানি ঢুকেছে। এ ছাড়া ডিএসসিসির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মুগদাপাড়া খাল এলাকার নিম্নাঞ্চলেও বন্যার পানি ছড়িয়ে পড়েছে।
এছাড়া রাজধানীর সবুজবাগ, বাড্ডা, বেরাইদ, ডুমনি, সাঁতারকূল, দক্ষিণখান, টঙ্গী, গাজীপুরের কাপাসিয়া ও কালীগঞ্জের দিকে প্রবাহিত বালু নদের তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলোও প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া বালু নদ তীরবর্তী নগরীর বিভিন্ন এলাকায় শাখা নদের সংযোগ ও ছোট-বড় সংযোগ খালেও বানের পানি ঢুকেছে। বন্যার পানিতে ১৫ দিন ধরে ডুবে আছে রূপগঞ্জের নিচু এলাকা। শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের পানি গতকাল বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সংবাদদাতা জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি কিছুটা কমলেও এখনো বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া বন্যা পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল রয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, চাঁদপুর থেকে জানান, চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া টুইটুম্বর। পানিবন্দিনিন্মাঞ্চলের মানুষ। গতকাল বিপদসীমার ৩৫ সে.মি. ওপর দিয়ে মেঘনা নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে পুরো বাংলাদেশের ৭০ ভাগ পানি চাঁদপুর হয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। এ কারণে শহর রক্ষা বাঁধ ঝুঁঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ফরিদপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুরের পদ্মা, মধুমতি ও আড়িয়ালখাঁ নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। পদ্মানদীর পানি বিপদসীমার ১১৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমলেও বন্যা কবলিত মানষের দূর্ভোগ কমেনি। এদিকে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দ্বিতীয়বারের মত ভেঙে যাওয়ায় শহরের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। জেলায় প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
গাইবান্ধা থেকে স্টাফ রির্পোটার জানান, গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৮ সে.মি. হ্রাস পেয়ে ফুলছড়ি পয়েণ্টে বিপদসীমার ৫৮ সে.মি. উপর দিয়ে ও ঘাঘট নদীর পানি শহরের ব্রিজ রোডে বিপদসীমার ৪০ সে.মি. উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অপরিবর্তিত রয়েছে।
জামালপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, জামালপুরে যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৭২ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদের পানি জামালপুর ফেরীঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, সকালে ব্রহ্মপূত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৩০ সে.মি. এবং ধরলা নদীর বিপদসীমার ৫ সেণ্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে জানান কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম।
মাদারীপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের ৭৭ নম্বর কাঁঠালবাড়ি সরকারি বিদ্যালয় ও সাইক্লোন সেন্টার ভবনটির অংশ বিলীন হয়ে যায় বলে প্রধান শিক্ষক নাসিমা আক্তার জানান। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৭৩ সে.মি. ও আড়িয়াল খাঁ বিপদসীমার ৩৫ সে.মি.টার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, পদ্মা নদীর পানি মাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৭ সে.মি. এবং ভাগ্যকুলে ৬১ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লৌহজেং ২১টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৫৭২টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।
নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা জানান, নওগাঁয় ছোট যমুনা ও আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে হু হু করে পানি প্রবেশ অব্যাহত থাকায় এখন প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ৫টি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের আড়াই লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি। এসব এলাকার সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
নাটোর জেলা সংবাদদাতা জানান, নাটোরের নলডাঙ্গা পয়েণ্টে বারনই নদীর পানি বিপদসীমার ১৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
শরীয়তপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা নদীতে পানি বিপদ সীমার ১৫ সে. মি. উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানি নামতে অনেকটা সময় লাগবে। পদ্মা সেতু এলাকার জিরো পয়েন্টে গাইড ওয়ালের প্রায় ৩০ মিটার ভেঙে গেছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, যমুনা নদীর পানি গতকাল বিকেলে সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে বিপদসীমার প্রায় ৭৯ সে. মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বর্তমানে যমুনা নদীতে পানি কমতে থাকলেও কমছে না বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ।
টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা জানান, টাঙ্গাইলে যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি এখনো বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ফিকে হয়ে আসছে টাঙ্গাইলের বানভাসি মানুষের আসন্ন ঈদের আনন্দ। পানি উন্নয়ন র্বোড সূত্রে জানা যায়, যমুনার পানি ৬১ সে.মি. ও ধলেশ্বরী নদীর পানি ১৬৩ সে.মি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
টঙ্গীবাড়ী (মুন্সীগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, পদ্মার পানি বৃদ্ধি ও লাগাতার বৃষ্টিতে ২য় দফায় মুন্সীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। প্রথম দফার বন্যার রেশ কাটতে না কাটতে পুনরায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, লৌহজং এবং টঙ্গীবাড়ী উপজেলার চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী ৩০ টি গ্রামের কয়েক হাজার বাসিন্দারা বিপাকে পড়েছে।