দক্ষিন এশিয়ায় মিঠাপানির মাছের ব্যাংক হালদা নদী তথা সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশ করোনাকালেও দিলো শুভবার্তা। মা-মাছের ডিম সংগ্রহে গেল এক যুগের রেকর্ড ভঙ্গ হলো। অবশেষে হালদায় রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ (কার্প) বড় জাতের মা-মাছের ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ আহরণ। সর্ত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ কিলোমিটার জুড়ে ডিম আহরণের উৎসব চলে। যে ডিম তথা মৎস্যবীজ থেকে সারাদেশে উৎপাদিত হবে শত শত কোটি টাকার মাছ। এ মুহূর্তে হালদা পাড় জেলে, এলাকাবাসী ও মৎস্যজীবীদের আনন্দ-উৎসবে মাতোয়ারা।
গতকাল পাহাড়ি খরস্রোতা হালদা নদীতে উজানের তুমুল বজ্রবৃষ্টি, ঘোলাস্রোত আসে। আগের রাতে কেটে গেলো ঘূর্ণিঝড় আম্পানের অবশিষ্ট বাধা। তখনই নদীর বাঁকে বাঁকে ভাঁজে ভাঁজে ঘূণিস্রোতে ডিম ছাড়লো রুই কাতলা মৃগেল মা-মাছেরা।
সকাল-বিকাল দলে দলে মা-মাছ ডিম ছাড়ে। নদীর তলদেশ থেকে ভেসে উঠে ওরা ডিম পাড়ার আনন্দ নিয়েই। সেই ডিম বিশেষ পদ্ধতির জাল দিয়ে সংগ্রহ করেন অভিজ্ঞ, দক্ষ জেলেরা। খুব সতর্কতার সাথেই ডিম সংগ্রহ করা হয়। এরপর রেণু ও পোনা ফোটানোর জন্য নির্দিষ্ট পানি ও তাপমাত্রার নার্সারি মাটির-কুয়ায় রাখা হয়।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের হালদা গবেষক, হালদা নদী গবেষণাগারের সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া জানান, এবার বছরজুড়ে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় হালদা নদী দূষণ, বালু তোলা, ড্রেজিং, মা-মাছ নিধন, জাল ফেলা, চাঁদাবাজি মাস্তানি কঠোরভাবে রোধ, দূষণকারী হিসেবে চিহ্নিত এশিয়ান পেপার মিলসসহ বিভিন্ন কারখানা ও বর্জ্যরে উৎসগুলো বন্ধ করা, উজানে মানিকছড়ির পাহাড়ি এলাকায় তামাক চাষ বন্ধ রাখা, নদীর গতিপথ স্বাভাবিক থাকতে দেয়ার ফলেই বিপুল পরিমাণে মা-মাছের ডিম পাড়া এবং সংগ্রহের এই সাফল্য ধরা দিয়েছে। যা সমগ্র দেশকে মৎস্যসম্পদে ভরপুর করতে সহায়ক হবে।
তিনি জানান, সর্বপ্রথম গতকাল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে হালদা নদীর তিনটি পয়েন্টে রুই কাতলা মৃগেল কালিবাউশ বড় (কার্প) জাতের মা-মাছেরা ডিম ছাড়তে শুরু করে। এরপর একে একে অনেকগুলো স্থানে ডিম ছাড়ার হিড়িক শুরু হয়। আবহাওয়া-প্রকৃতি ভাল। তাই পর্যাপ্ত ডিম ছেড়েছে মা-মাছেরা। ডিম সংগ্রহেও রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে।
গতকাল দিনভর জেলেরা ডিম সংগ্রহ করেন। রেণু পোনা ফোটানোর জন্য মাটির নার্সারি কুয়ায় ছুটেছেন। হালদা নদীর রামদাস হাট পয়েন্টসহ বিভিন্ন স্থানে ড. মনজুরের গবেষক দল মা-মাছের ডিম ছাড়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে করেন। প্রথম দিকে নাপিতের ঘোনা, আমতুয়াসহ তিনটি স্থানে প্রথমে মা-মাছ ডিম ছাড়ে। এরপর আরও এক ডজন স্থানে ডিম ছাড়ে। বিশেষ জালে আহরণও চলে। এবার হালদার কাগতিয়া আজিমের ঘাট, খলিফার ঘোনা, পশ্চিম গহিরা অংকুরী ঘোনা, বিনাজুরী, সোনাইর মুখ, আবুরখীল, খলিফার ঘোনা, সাত্তারঘাট, দক্ষিণ গহিরা, মোবারকখীল, মগদাই, মদুনাঘাট, উরকিচর, গড়দুয়ারা, নাপিতের ঘাট, সিপাহির ঘাট, আমতুয়া, মার্দাশা এলাকায় ডিম আহরণ হয় বেশিহারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অমাবস্যার ‘জো’-তে মা-মাছেরা ডিম ছেড়েছে। এরআগে আবহাওয়া-প্রকৃতি অনুক‚ল না থাকায় হালদায় পরপর তিন ‘জো’ গেছে ডিমশূন্য। অনিশ্চয়তায় হাজারো জেলে ছিলেন উৎকণ্ঠিত অপেক্ষায়। ঘূর্ণিঝড় আম্পান কেটে যেতেই বজ্রবৃষ্টির সাথে উজানের ঘোলাস্রোতে হালদায় ডিম ছাড়ার অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি হয়। গত বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ির পাহাড়ি এলাকায় অতিবৃষ্টিতে আসে তীব্র ঘোলাস্রোত। সেই সাথে উত্তর চট্টগ্রামে হয় বজ্রবৃষ্টি। হালদায় মা-মাছের ডিম ছাড়ার জন্য এটাই আবহাওয়াগত পূর্বশর্ত।
এশিয়ায় মিঠাপানির রুই কাতলা বড় (কার্প) জাতীয় মাছের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক জোয়ার-ভাটা নির্ভর হালদা দেশের অর্থনৈতিক নদী ও মাছের ব্যাংক। এ নদীর সরাসরি বার্ষিক অবদান প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা। হালদার রুই কাতলা মৃগেল এশিয়ায় মৌলিক জাতের। এরজন্য সেগুলো অল্প সময়েই দ্রæত বর্ধনশীল। বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মৎস্য চাষিরা হালদার ডিমে ফোটানো রেণু পোনা সংগ্রহে উদগ্রীব।
হাটহাজারীর সৃজনশীল ইউএনও মো. রুহুল আমীন হালদা সুরক্ষায় মাঠে তৎপর এবং কঠোর অবস্থানে থাকেন। স্থানীয় জেলেরা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে হালদার উজান-ভাটিতে দুই দফায় তুমুল বৃষ্টিপাত হয়। মুষলধারে বৃষ্টি নামে বজ্রপাতসহ। এ সময় মাঝরাত ১২টার দিকে হালদায় ‘নমুনা ডিম’ দিতে শুরু করে মা-মাছেরা। প্রকৃতির আপন নিয়মেই মা-মাছ পরখ করে দেখে, নদীতে ডিম ছাড়ার পরিবেশ তৈরি কিনা। এরজন্য মা-মাছ কয়েকশ’ ডিম প্রথমে ছেড়ে দেয়। যাকে বলা হয় ‘নমুনা ডিম’। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পুরোদমে ডিম ছাড়া শুরু করে। তখনই ওদের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। ছোটাছুটি করে নদীর বুকে।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে হালদা নদীর কয়েকটি স্পটে নমুনা বা পরীক্ষামূলক ডিম ছাড়ে রুই কাতলা মা-মাছ। তখনই জেলেরা ডিম ছাড়ার সবুজ সঙ্কেত পেয়ে যান। সকালে শুরু হয় মা-মাছের সদলবলে পুরোদমে ডিম ছাড়ার পালা। ডিম ছাড়ার পর অপচয় যাতে না ঘটে এবং সর্বত্র সুষ্ঠু বাজারজাত নিশ্চিত করা হয় এ বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞগণ।
এবার হালদায় মা-মাছের ডিম সংগ্রহে এক যুগের রেকর্ড (২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি) ভঙ্গের আগে গতবছর ২৫ মে ৭ হাজার কেজি ডিম মিলে। ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ডিম ছাড়ে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। তখন দশ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ হয়। ২০১৭ সালে ডিম মিলে এক হাজার ৬৮০ কেজি।উৎস- ইনকিলাব