পূর্বাচলে আইকনিক টাওয়ার ঘিরে নির্মিত হচ্ছে একটি বিশাল বাণিজ্যিক জনপদ। ‘সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক’ (সিবিডি) নামে বাণিজ্যিক জনপদটি নির্মিত হচ্ছে ১১৪ একর জায়গার ওপর। আট বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পে ৯৬ তলা আইকনিক টাওয়ারের পাশাপাশি থাকবে ৪১টি আকাশ ছোঁয়া ভবন। এর মধ্যে থাকবে একটি ৭১ তলা লিবার্টি টাওয়ার, একটি ৫২ তলা ল্যাঙ্গুয়েজ টাওয়ার। বাকি ৩৮টি টাওয়ার হবে ৪০ তলার সমান উচ্চতা সম্পন্ন। বাংলাদেশের সিকদার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার প্যাক এবং জাপানের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান কাজিমার মিলিত কনসোর্টিয়াম এই বিশাল প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছে। এতে বাংলাদেশ-জাপানের কারিগরি সহায়তা ছাড়াও থাকবে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ফ্রান্স এবং ভারতের কারিগরি সহায়তা। পূর্তমন্ত্রী শম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্টের মাধ্যমে ঢাকাকে চিনবে গোটা বিশ্ব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ৪১ এর লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এ ধরনের প্রকল্পের বিকল্প নেই। সিবিডি থেকেই এশিয়ার বাণিজ্য কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এই বিশেষায়িত ব্যবসায়িক অঞ্চল দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের চেহারা পাল্টে দেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। ইতোমধ্যে জমির দশভাগ মূল্য নেয়া হয়েছে। ডিজাইন পাশের পর দ্রুত কাজ শুরু করা হবে বলে আমরা আশা করি। পাওয়ার প্যাক-কাজিমা কনসোর্টিয়ামের চীফ অপারেটিং অফিসার ও পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য রাজউকের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলে ২০২০ সালের মার্চ মাসেই আমরা উন্নয়ন কাজ শুরু করতে পারব।

দেশে বাণিজ্যিক স্থানের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে রাজধানীর অদূরে পূর্বাচল নতুন শহর এলাকায় নেয়া হয়েছে এই প্রকল্প। পূর্বাচল প্রকল্পের ৯নং সেক্টরে মোট ১১৪ একর জমি বরাদ্দ রাখা হয়েছে এই বাণিজ্যিক জেলার জন্য। ১৯১৮ সালে উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পায় পাওয়ার প্যাক-কাজিমা কনসোর্টিয়াম। পাওয়ার প্যাক-কাজিমার কনসোর্টিয়াম ইতোমধ্যে রাজউককে ৩১৭ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা অগ্রিম পরিশোধ করেছে যা মোট জমিমূল্যের ১০ শতাংশ। সাত বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন বাস্তবায়নকারী কনসোর্টিয়াম।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায়ীক এ বিশাল জনপদে ৪১টি আকাশছোঁয়া ভবন থাকবে যার মধ্যে ৪৬৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট ৯৬ তলা আইকনিক লিগ্যাসি টাওয়ার, ৭১ তলাবিশিষ্ট লিবার্টি টাওয়ার এবং ৫২ তলাবিশিষ্ট ল্যাঙ্গুয়েজ টাওয়ার। প্রায় ৩৮ দশমিক ৪৪১ মিলিয়ন (৩৮৪৪ কোটি ১০ লাখ) বর্গফুট ব্যবসায়ের এ ভবনগুলোর কক্ষে থাকার ব্যবস্থাও থাকবে। এছাড়া অন্যান্য ৩৮ আকাশচুম্বী ভবনের মধ্যে প্রতিটির উচ্চতা ৪০ তলা ভবনের সমান হবে। শহরটিতে থাকবে একটি বৃহৎ সম্মেলন কেন্দ্র। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। পাওয়ার প্যাক প্রকল্পের শীর্ষস্থানীয় স্পন্সর হিসেবে কাজ করবে এবং প্রযুক্তিবিদ অংশীদার হিসেবে থাকবে কাজিমার। পাওয়ারপ্যাক কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটি বরাদ্দ পাওয়ার পরপরই নির্মাণ ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগের জন্য পাওয়ার চায়না ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ লিমিটেডের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। বিশ্বের ৭ম বৃহৎ স্থাপত্য সংস্থা দক্ষিণ কোরিয়ার ‘হেরিম আর্কিটেক্ট এ্যান্ড প্ল্যানার্স কোঃ লিমিটেড’কে প্রকল্পের স্থপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ফরাসী প্রতিষ্ঠান ‘আরকিটাইপ কনস্ট্রাক্টশন হোল্ডিংস লিমিটেড’কে কনস্ট্রাকশন এ্যান্ড প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট করার দায়িত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কে মাটি পরীক্ষা করা এবং ভারতের প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার (পিডব্লিউসি) কে ট্রাফিক ইমপেক্ট এ্যাসেসমেন্ট (টিআইএ) ও পরিবেশ প্রভাব জরিপ বা এনভায়রনমেন্টাল ইমপেক্ট এ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) নির্ণয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ করা হয়। একইসঙ্গে প্রকল্পটি বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে কিনা তার সম্ভাবতা যাচাইয়ের জন্য পিডব্লিউসিকে নিয়োগ দেয়া হয়।

প্রকল্পের উন্নয়ন পরিকল্পনার সামগ্রিক অগ্রগতি পর্যালোচনা করার জন্য সম্প্রতি রাজউক সম্মেলন কেন্দ্রে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাজউক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পাওয়ার প্যাক-কাজিমা কনসোর্টিয়াম, হেরিম আর্কিটেক্ট, প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারের প্রতিনিধিগণ ও রাজউকের সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে পাওয়ার প্যাক কাজিমার আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল একটি মাস্টারপ্ল্যান, বিল্ডিং লে-আউট ডিজাইন, ভূমিকম্প সহনশীল আধুনিক প্রযুক্তি ও স্মার্ট সবুজ শহরের পরিকল্পনা নিয়ে একটি পাওয়ার পয়েন্ট ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা করে।

পাওয়ার প্যাক কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেন যে, বাণিজ্যিক স্থানের চাহিদা মেটাতে সিবিডি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বর্তমানে এই চাহিদার কারণে অনেক আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এইসব এলকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাও নেই যা থাকবে এই প্রকল্পটিতে। ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক শহরে আবাসিক এলাকাও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পাওয়ার প্যাক কর্মকর্তারা জানান, পূর্বাচল সিবিডির খোলা জায়গা থাকবে ৫৭ একর ও অতিরিক্ত সবুজ অঞ্চল হবে ১২ দশমিক ৫০ একর। এছাড়া ২০টি টাওয়ারে অফিস স্পেস থাকবে ১২ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন বর্গফুট এবং ১৫টি টাওয়ারে ৩ হাজার ৮৫৮টি আবাসিক ইউনিট থাকবে। প্রকল্প এলাকায় ৪০ হাজার গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা থাকবে।

জানতে চাইলে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের পরিচালক উজ্জল মল্লিক জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশকে ২০৪১ সালে উন্নত দেশের তালিকায় নিয়ে যেতে সরকারের নেয়া উদ্যোগ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পূর্বাচলে একটি বিশেষ এলাকায় কেন্দ্রীয় বিজনেস অঞ্চল (সিবিডি) গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বের নামকরা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান শিকদার গ্রুপ যৌথভাবে কাজ করছে। ইতোমধ্যেই এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকার চুক্তি করেছে। এই অঞ্চলটিতে কি কি থাকবে, কোন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে তার নক্সা আশা করি ২০২০ সালের জুনের মধ্যেই স্পষ্ট হবে। এরপরই উন্নত বিশ্বের মতো বিজনেস ডিস্ট্রিকটি গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেন, প্রকল্পে এমন সব প্রতিষ্ঠান থাকবে যার মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশকেই চেনা যাবে। বর্তমানে কোন বড় আকারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর বা ব্রাজিলে যেতে হয়। সিবিডির ব্যবসায়িক জনপদটি গড়ে তোলা হবে আইকোনিক হিসেবে। এক সীমানায় পাওয়া যাবে বিশ্বের সব বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গন্তব্য। মূল আইকনিক টাওয়ার প্রাথমিকভাবে ৯৬ তলা সর্বোচ্চ ভবন বলা হলেও এটিকে ১০৮ তলা করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রায় ৪০ হাজার গাড়ি এই সীমানায় নিরবচ্ছিন্নভাবে চলাচলের ব্যবস্থা থাকবে। এর আশপাশে অসংখ্য ছোটবড় ভবন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম, আন্তর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টার নির্মাণসহ বিশ্বেও অসংখ্য ফাইভ স্টার সেভেন স্টার হোটেল নির্মাণ করা হবে। প্রকল্প পরিচালক বলেন, জমির অর্থ প্রাপ্তি স্বাপেক্ষে আমরা চুক্তিকারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ শুরু করার অনুমতি দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। তবে প্রথমে আইকনিক টাওয়ার ও পরে সকল স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। ডিজাইন পাস করার পর ৪ বছরের মধ্যেই এই আইকনিক টাওয়ার নির্মাণ করা সম্ভব হবে।উৎস- জনকন্ঠ