বাংলার মসলিন বস্ত্রশিল্পের খ্যাতি ছিল একদা দুনিয়াময়। জামদানি, ঢাকাই, টাঙ্গাইল ও মিরপুরী কাতান শাড়ীর ঐতিহ্য নিভু নিভু অবস্থায় টিকে আছে। চাটগাঁর গনি বেকারীর শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘বেলা’ ‘নিমকি’ ‘খাস্তা’ বিস্কুট, আদি ঢাকার ‘বাকরখানি’সহ হরেক বেকার্স খাদ্যসামগ্রী বিলাত, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, জাপান ও অনেক দেশে সৌখিন লোকদের চায়ের টেবিলে পৌঁছে যাচ্ছে।

মহেশখালীর রসালো সুমিষ্ট পানের খিলি লখনৌর (ভারত) পানকেও হার মানায়। রাজশাহীর সিল্ক, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঁশ, বেত, কাঠ, মাটি ও হরেক বুনো উপকরণ দিয়ে তৈরি হস্ত-কুটিশিল্প, গহনা, তাঁতবস্ত্র ও বয়ন শিল্পপণ্যের কদর দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে গেছে।

তবে শত ধরনের অপ্রচলিত কিংবা কম প্রচলিত পণ্যসামগ্রী রফতানি হচ্ছে সামান্য। আর পর্যটকরা আগ্রহভরে স্মারক হিসেবে কিছু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। অথচ ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশে^র অনেক দেশেই বাংলাদেশে উৎপাদিত নজরকাড়া এসব পণ্যের প্রকৃত চাহিদা রয়েছে অবিশ্বাস্য মাত্রায়। অর্থনীতিবিদ, বণিক-শিল্পোদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এদেশের চারু-কারু শিল্পী, গৃহবধূ ও চাষাদের পটু হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে হাজারো রকম অপ্রচলিত পণ্য।

পরিকল্পিত উদ্যোগ নেয়া হলে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ ও বৈচিত্র্যের সাথে বাজার প্রসারের মধ্যদিয়ে আয় আসতে পারে শত শত কোটি ডলার। কাছের দেশ নেপাল, ভুটান, ভারত, চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের অপ্রচলিত পণ্য রফতানি তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশের অপ্রচলিত ও কম প্রচলিত বিচিত্র পণ্য রফতানি বাজার প্রসার ও আয়বৃদ্ধির অপার সুযোগ-সম্ভাবনা অধরাই রয়ে গেছে। এ খাতে খুলে দেয়া সম্ভব লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের দুয়ার। অপ্রচলিত ও কম প্রচলিত রফতানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে নকশী টুপি, নকশী কাঁথা, পান-সুপারি-খয়ের, চিড়া-মুড়ি, নাডু-মোয়া, মানুষের পরিত্যক্ত চুল, ভাঙা কাচ, বাঁশ-বেত ও পাহাড়ি বা বুনো উপকরণ দিয়ে তৈরি গৃহসজ্জার সামগ্রী ও শোপিস, ছোট আকারের আসবাবপত্র, পাটজাত দ্রব্য, থলে বা ব্যাগ, নারকেলের ছোবড়া ও কলাগাছের আঁশ থেকে তৈরি বস্ত্র ও বিভিন্ন সামগ্রী।

আরও আছে মিষ্টি জর্দাসহ পানের রকমারি মসলাপাতি, খৈ, গুড়, আলুর চিপস, চানাচুর, তাজা দেশজ ও জংলী ফুল, কাগজ ও সিনথেটিক কাপড়ের তৈরি ফুল, মৃৎ শিল্পজাত পণ্য, বাঁশের ফালি, মাটি ও ইমিটেশনের গহনা, পার্স, খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাত, মৌসুমী ফলমূল সংরক্ষণ করে অপচয়রোধ ও প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি জুস, আচার, লজেন্স, মধু, হারবাল ও ঔষধী দ্রব্য, বিস্কুট ও বেকার্স খাদ্যসামগ্রী, প্লাস্টিকজাত দ্রব্য, খেলনা প্রভৃতি দেশজ পণ্যসামগ্রী।

এ প্রসঙ্গে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির (ইডিইউ) ভিসি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, অপ্রচলিত ও কম প্রচলিত পণ্য উৎপাদনকারীরা দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় থাকেন। তারা অবহেলিত। সংগঠিত নয়। তিনি বলেন, ‘যাদের কেউ নেই তাদের জন্য সরকার আছে’ এই কনসেপ্টের ভিত্তিতে গ্রামীণ মানুষের জন্য নগদ প্রণোদনাসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে হবে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) উচিৎ প্রান্তিক জনগণের হাতে তৈরি পণ্য বিদেশে রফতানির সুযোগ উৎপাদকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। যাতে বুঝতে পারে তারা এতে স্বাবলম্বী হবে।

বিশিষ্ট ফ্যাশন ডিজাইনার ডল’স হাউসের প্রতিষ্ঠাতা আইভী হাসান বলেন, আমরা যারা দেশীয় বস্ত্রশিল্প বিকাশের জন্য কাজ করছি তারা বলতে গেলে হুমকির মুখে। জামদানি, রাজশাহী সিল্ক, তাঁতবস্ত্র প্রভৃতি উপকরণের মূল্য অনেক চড়া। ডিজাইনাররা কাজ করার পর উৎপাদন মূল্য সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। মুষ্টিমেয় ক্রেতা দিয়ে তো আর ব্যবসা চলে না। অন্যদিকে ভারত,পাকিস্তান আর চায়না থেকে আসা কাপড়ের দাম তুলনামূলক অনেক কম। তিনি বলেন, আমাদের পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরে যেতে হবে। দেশীয় পণ্যের ওপর ট্যাক্স হ্রাস, তাঁতীদের উৎসাহ ভাতা দিয়ে কর্মোদ্যেগী করে তুলতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পণ্যকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে।

উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (বিআইডিএস) এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পৃথক গবেষণায় বলা হয়েছে, একক পণ্য নির্ভরতা বাংলঅদেশের রফতানিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। মোট রফতানির ৮৪ ভাগই তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। অথচ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী রফতানির ব্যাপক সম্ভাবনা কাজে লাগানো হচ্ছে না। রফতানি পণ্যের ক্ষেত্রে যেমন বহুমুখীকরণ করতে হবে, তেমনি রফতানি বাজারেরও বহুমুখীকরণ প্রয়োজন। অন্যথায় রফতানি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। অতিমাত্রায় নির্ভরশীল গার্মেন্টস পণ্যের বাজার আমেরিকা-ইউরোপেই সীমিত।

এ অবস্থা অতিক্রম করতে হলে নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান, রফতানি পণ্যের বহুমুখী ও বৈচিত্র্যকরণ বাংলাদেশের রফতানি প্রসারের জন্য অপরিহার্য। নিজস্ব মানবসম্পদ ও সৃজন শক্তিকে কাজে লাগিয়ে রফতানিযোগ্য হরেক অপ্রচলিত বা কম প্রচলিত পণ্যের উৎপাদন এবং বাজার চাহিদা আয়ত্তে নেয়ার কৌশল দরকার।

এবার চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় (সিআইটিএফ) কলাগাছের আঁশ থেকে তৈরি বস্ত্র ও চারু-কারু, সৌখিন চোখ ধাঁধানো পণ্যসামগ্রীর একটি স্টলে ছিল দর্শনার্থীর ভিড়। জাদুকির হাতের সূক্ষè কারুকাজে সামান্য কলাগাছের আঁশ দিয়ে হাজার হাজার টাকা দামের ডজন খানেক ধরনের নজরকাড়া জিনিসপত্র সেখানে বিকিকিনি হয়। উদ্যোক্তা মিলন জানান, সরকারের তরফ থেকে প্রণোদনা পেলে লাখ টাকা দামি সুনিপুন কারুকাজের পণ্য তৈরি করে বিদেশে রফতানি সম্ভব।

বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় ছড়িয়ে থাকা হস্ত ও কুটির শিল্পীদের হাতের জাদুতে শত রকমের পণ্যসামগ্রী বিদেশের বাজারে রফতানির চাহিদা রয়েছে। অভাব কেবল উদ্যোগের। উদ্যোগ না থাকায় চারু-কারু ও বয়ন শিল্পীরা হারিয়ে ফেলেছে সৃষ্টির সুখ ও উদ্যম।

উৎসঃ ইনকিলাব