দেশীয় সুতা ও কাপড়ের বস্ত্রশিল্প এখন প্রায় ধ্বংসের পথে। বন্ড সুবিধায় আনা বিদেশি সুতা-কাপড়ের কালোবাজারি বন্ধ না হওয়ায় স্থানীয় মিলের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি মুখ থুবড়ে পড়েছে।

ছোট-বড় মিলে চার শতাধিক স্পিনিং মিলে অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে ৮ লাখ টনের বেশি সুতা। কাপড়ের মিলগুলোর অবস্থাও একই রকম। এ কারণে বেশিরভাগ মিল মালিক ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। খেলাপি হতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু সব জেনেও সরকারের দায়িত্বশীল মহল যেন নির্বিকার।

এর ফলে মাসের পর মাস লোকসান গুনতে গিয়ে ছোট মিলগুলোতে তালা ঝুলতে শুরু করেছে। বড় মিলগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে। উপরন্তু, পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিদেশ থেকে সুতা ও কাপড় আমদানির নামে এলসি মূল্য বাড়িয়ে চলছে নিবিঘ্নে অর্থ পাচার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে দেশীয় বস্ত্র খাত আর বেশিদিন বাঁচানো যাবে না। আগামী ৬ মাসের মধ্যে বেশিরভাগ মিল বন্ধ হয়ে যাবে। যদি মিলগুলো বাঁচাতে হয় তাহলে বাংলাদেশে উৎপাদিত সুতার সমমানের বিদেশি সুতা এক বছরের জন্য আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে নগদ সহায়তা ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ দিতে হবে। এ অর্থ দ্রুত প্রদানের ক্ষেত্রে সব বাধা দূর করতে হবে। পাশাপাশি যেসব উদ্যোক্তা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না তাদের ঋণ পরিশোধে যৌক্তিক সময়ও দিতে হবে।
প্রতিযোগী চীন, ভারত ও ভিয়েতনাম কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, দক্ষ মানবসম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও সেখানকার সরকার এ শিল্পের উন্নতি ধরে রাখতে নানামুখী প্রণোদনা অব্যাহত রেখেছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশে এ সেক্টরের প্রায় সবকিছু আমদানি নির্ভর হওয়া সত্ত্বেও সরকার এক রকম উদাসীন। নামমাত্র প্রণোদনা দেয়া হলেও তা পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উৎপাদন খরচ।

গত কয়েক বছরে দফায় দফায় বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ কয়েক দফায় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেয়ার পরও ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামানো যায়নি। অন্যদিকে কাস্টমস ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় বন্ডের আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা সুতা ঢুকে পড়ছে খোলা বাজারে। এতে সুতা শিল্পের উদ্যোক্তাদের বড় ধরনের অসম বাজার প্রতিযোগিতার পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব কারণে দেশের স্পিনিং মিলগুলোতে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে। বাস্তবতা হল, সংকটের সমাধান না হলে কেউ ব্যাংকের টাকা দিতে পারবে না। ব্যাংকও কোনোদিন টাকা ফেরত পাবে না। ইতিমধ্যে সে রকম আলামত শুরু হয়ে গেছে। তাই এ সেক্টরের মিলগুলো না বাঁচলে ব্যাংকও বাঁচবে না। কেননা, ব্যাংকের বেশিরভাগ বিনিয়োগ এ খাতে। তাদের মতে এ সংকট থেকে দ্রুত মুক্ত হতে চাইলে সরকারকে শক্ত হাতে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, দেশে যেসব ক্যাটাগরির সুতা উৎপাদিত হয় তা ১ বছরের জন্য পুরোপুরি আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নগদ সহায়তার পরিমাণ ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ করতে হবে। তৃতীয়ত, সৃষ্ট আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে এ খাতের ব্যাংক ঋণ পুনর্গঠনসহ ঋণ পরিশোধের জন্য গ্রহণযোগ্য সীমার গ্রেস প্রিরিয়ড নির্ধারণ করতে হবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বস্ত্র খাতের সমস্যা নিয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহলে বহু দেনদরবার করেছি। চিঠি দিয়েছি কয়েক দফায়। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। আসলে সরকার এখন শুধু অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে মনোযোগী। কিছু ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এর সুফলভোগী। সব ক্ষেত্রেই তারা সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন থেকে অবদান রাখা বস্ত্র খাত নিয়ে কেউ ভাবছে না। তিনি বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই বস্ত্র খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। কেউ ব্যাংকের টাকা দিতে পারবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে প্রতি কেজি দেশি সুতার দাম আড়াই ডলার। যদিও এ দরে বিক্রি করেও অনেকে খরচ তুলতে পারছেন না। অপরদিকে বন্ড সুবিধায় আনা ভারতীয় সুতা বিক্রি হয় ২ ডলার ৩০ সেন্টে। বাস্তবে এসব সুতা আনতে এলসি খোলা হয় ৩ ডলারের বেশি। এভাবে একটি চক্র বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে গত ৬ মাসের সুতার আমদানির তথ্য যাচাই-বাছাই করলেই থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে।

এদিকে এভাবে আমদানি করা সুতা স্থানীয় বাজার দখল করে নিচ্ছে। অথচ দেশীয় শিল্প বাঁচাতে সরকারের তরফ থেকে কার্যকর কোনো প্রটেকশন নেই। উল্টো দেশীয় সুতার বাজারকে অসম প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। যেটি কোনো সরকারের নীতি হতে পারে না। এ অবস্থায় প্রতিটি মিলে অবিক্রীত সুতার পাহাড় জমছে। বড় বড় মিলগুলোতে ১০ থেকে ২০ হাজার টন পর্যন্ত সুতা বিশাল বোঝা হয়ে ভর করেছে। উক্তোদ্যা সংগঠনের কয়েকজন নেতা যুগান্তরকে বলেন, চার শতাধিক সুতার মিলে গড়ে কমপক্ষে ২ হাজার টন সুতা অবিক্রীত অবস্থায় থাকলেও যার পরিমাণ ৮ লক্ষাধিক টন। যদিও বাস্তবে এর পরিমাণ আরও বেশি।
দেশীয় সুতার দুরাবস্থার পেছনে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিও বড় বিষয়। গত কয়েক বছর যাবৎ ক্রমাগতভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করায় স্বাভাবিকভাবে সুতার উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ২০১৫ সালে এক কেজি সুতা উৎপাদনে যেখানে সাড়ে ৭ টাকার গ্যাস খরচ হতো, এখন সেখানে সাড়ে ২৪ টাকার গ্যাস লাগছে। কিন্তু আগের দামে সুতা বিক্রি করতে গিয়ে লোকসান বাড়ছে।

এদিকে স্পিনিং মিলগুলোর অবস্থা এত করুণ যে মালিকরা এখন মুনাফার জন্য নয়, শুধু শ্রমিকদের বেতন দিতে কারখানা চালু রাখতে বাধ্য হচ্ছে। স্বনামধন্য ব্যবসায়ীরা অর্জিত সুনাম ধরে রাখার স্বার্থে অন্য খাত থেকে অর্থের জোগান দিয়ে শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছেন। কেউ কেউ লোকসানে সুতা বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণের টাকা পরিশোধ করছেন। তারপরও অনেকে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে এ খাতে নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, পুরনো বিনিয়োগ টেকানোই এখন কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

এত প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলার পর দেশীয় সুতা খাতে সরকার ৫ শতাংশের যে নগদ প্রণোদনা দেয় তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। যদিও এ প্রণোদনা অর্থ পেতে ঝক্কি-ঝামেলার শেষ নেই। পদে পদে হয়রানিতে পড়তে হয়। মূলত এ অর্থ প্রদানে জটিল নীতিমালার কারণে উদ্যোক্তাদের ঘাটে ঘাটে হয়রানি হতে হচ্ছে। ফলে সময়মতো সহায়তার অর্থ পাওয়া যায় না। সবকিছু ঠিক থাকার পরও অনেক ক্ষেত্রেই নগদ সহায়তার অর্থ পেতে দু-তিন বছর লেগে যায়। শুধু হয়রানি নয়, এর সঙ্গে দুর্নীতিও ভর করেছে। অভিযোগ আছে, যারা বাধ্য হয়ে গোপনে ঘুষ কমিশন দেন তাদের ফাইল আগে রিলিজ করা হয়।

শাহ ফতেহউল্লাহ টেক্সটাইল মিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বিটিএমএ পরিচালক শাহিদ আলম বলেন, আগে সরকার চাইত কিভাবে শিল্পকে সহায়তা দেয়া যায়। সে জন্য স্পিনিং ও উইভিং শিল্পে উদ্যোক্তারা লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এখন অবস্থা এতই বেগতিক যে, স্পিনিং ও উইভিং খাতের টিকে থাকাই কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, বন্ড সুবিধায় সুতা আমদানি স্পিনিং মিলগুলোর জন্য বড় সমস্যা। অনেক গার্মেন্টস আছে যেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও সেগুলোর নামে বন্ডের আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা-কাপড় আমদানি করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে সরকার যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয় তাহলে বস্ত্রশিল্প বেশিদিন বাঁচানো যাবে না। পাশাপাশি দেশে নতুন শিল্প গড়ে উঠবে না।

হাজী আবুল হাশেম স্পিনিং মিলের স্বত্বাধিকারী এসএম সোলায়মান জানান, বেশি দামে আমদানিকৃত তুলা দিয়ে সুতা ও কাপড় তৈরি করে মিল মালিকরা চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন। এভাবে মাসের পর মাস লোকসান দিয়ে এবং ব্যাংকের ঋণ ও সুদ গুনতে গিয়েই সব কিছু বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

ক্লথ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও এফবিসিসিআইর পরিচালক প্রবীর কুমার সাহা জানান, বন্ড সুবিধায় সুতা ও কাপড় এনে যারা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছেন তাদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স ভূমিকা নেয়ার কথা এনবিআর থেকে বলা হয়েছে। পাট শিল্প যেমন ধীরে ধীরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে, তেমনি এখনই উদ্যোগ নেয়া না হলে বস্ত্র খাতের পরিণতিও সেদিকে যাবে।

ইয়ার্ন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি লিটন সাহা বলেন, শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধা অপব্যবহারের কারণে দেশে এক লাখের মতো তাঁতের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ এখন বন্ধ। রফতানিমুখী সুতা এবং কাপড় উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত মিলগুলোও চোরাই পথে আমদানি করা সুতার কারসাজিতে বিপদে পড়েছে। এসব কারণে উৎপাদন ক্ষমতার ৬০ শতাংশ কমিয়ে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে মিলগুলো। তিনি জানান, এ সংকট নিরসনে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বিদেশি সুতা ও বস্ত্রের বাজারে পরিণত হবে দেশ। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হবে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হবে, যা বস্ত্র খাতের জন্য বড় অশনিসংকেত।সূত্র-যুগান্তর