কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ৯৩তম জন্মবার্ষিকী আজ। বাংলা কাব্য, নাটক ও প্রবন্ধ সাহিত্যে অসাধারণ প্রতিভাধর এই কবি স্বল্প সময়ে লেখালেখি করেও বিপুল মেধার স্বাক্ষর রাখেন এবং খ্যাতি লাভ করেন।
সুকান্ত ভট্টাচার্য (জন্মঃ১৫ই অগাস্ট ১৯২৬ মৃতুঃ ১৩ই মে ১৯৪৭) বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, পরাধীনতার গ্লানি, দারিদ্র, স্বপ্নভঙ্গ কি নতুন আশার দিশা ছিল তাঁর কবিতায়, মাত্র ২১ বছর তাঁর জীবনকাল, তবু তাঁর কবিতা দাগ রেখে যায় বাঙ্গালীর মননে।

রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের একটি অবিস্মরণীয় নাম সুকান্ত ভট্টাচার্য। দাদামশাই সতীশচন্দ্র ভট্টাচার্যের ৮২ নং মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়ির দোতলায় একটি ছোট্ট ঘরে জন্মগ্রহন করেন সুকান্ত। ১৯২৬ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলা ১৩৩৩ সালের ৩০ শ্রাবণ। পিতা নিবারণ ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সুনীতি দেবীর দ্বিতীয় পুত্র তিনি। জেঠতুতো দিদি রাণীদি নাম রাখের সুকান্ত, ‘রমলা’ খ্যাত সাহিত্যিক মনীন্দ্রলাল বসুর গল্প ‘সুকান্ত’-এর নামে। বাগবাজারের নিবেদিতা লেনের বাড়ির একান্নবর্তী পরিবারে কাটে তাঁর ছেলেবেলা। এরপর সেই বাড়ি ছেড়ে আসা হয় বেলেঘাটার ৩৮ নং হরমোহন ঘোষ লেনে। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার(বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)।

কবি সুকান্তের সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে তাঁর নয় দশ বছর বয়স থেকেই। স্থানীয় প্রাথমিক স্কুল কমলা বিদ্যামন্দিরে পড়ার সময় সেখানকার চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্ররা মিলে একটি হাতে লিখা পত্রিকা বের করে। সুকান্ত এই পত্রিকার নাম দেন “সঞ্চয়” , এতে তিনি নিজেও একটি হাসির গল্প লিখেন। ছেলেবেলাতে সুকান্ত অভিনয়েও পারদর্শীতা দেখান। স্কুলের নাটক “ধ্রুব”তে তিনি নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৯৪১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যান। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে সুকান্ত রেডিওতে গল্পদাদুর আসর নামে এক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করে প্রশংসা লাভ করেন সবার।

বিশ্ব জুড়ে তখন ২য় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে। পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে একদিকে ছড়িয়ে পড়েছে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আরেকদিকে তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ। কবি সুকান্ত এসব কিছুকেই করে তোলেন তাঁর কবিতার উপজীব্য।

সাম্যবাদে বিশ্বাসে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯৪২ সালে যোগ দেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৪৪ সালে সুকান্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৫ এর আগে তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে যান। ফলে ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হন। সুকান্তের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অবসান হয় সেখানেই।

জনগণের কবি সুকান্তের সমাজ-সচেতনতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও সাহসী কলমে তাঁর শক্তির প্রকাশের সাথে যদি যুক্ত হত তাঁর বয়সের পূর্ণতা ও অভিজ্ঞতা, তাহলে বাংলা সাহিত্য জগৎ বৃহৎ ক্ষেত্রে পূর্ণতা লাভ করতে পারতো। তা সত্ত্বেও সুকান্ত তাঁর অপরিণত যৌবনেই এমন কবিতা লিখে গেছেন যা সুপরিণত এবং এই সকল রচনার মাধ্যমেই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
সুকান্তের সমস্ত জীবনটাই ছিল কবিতার সাথে একাত্ম। তাঁর আগুন-ঝরানো কলমে ফুটে ওঠে বিদ্রোহের গান-
“আমার দিন পঞ্জিকায় আসন্ন হোক
বিস্ফোরণের চরম, পবিত্র তিথি”
তাঁর বিদ্রোহ সকল মানুষের জন্য, জীবনের জন্য –
“হে সূর্য।
তুমি আমাদের স্যাঁতসেতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও,
আর উত্তাপ দিও
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে”।

আরেক কবিতায় বলেন- ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় / পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। কাব্য সাহিত্যে এমনই সব অমর কাব্যগাথা রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘যে আছে মাটির কাছাকাছি, সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি’। সুকান্ত ছিলেন সেই মাটির কবি, তাই তাঁর কবিতা আমাদের হৃদয়ের এত কাছাকাছি। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যাধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের ১৩ মে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। জন্মদিনে আমাদের এই প্রিয় কবিকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।অথ্যসূত্র-ইন্টারনেট