শহুরে জীবনের হাজারো সমস্যার মধ্যে অন্যতম খাঁটি খাবার খুঁজে পাওয়া, বিশেষত ভেজাল খাবারের এ নগরীতে মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজছে খানিকটা ভিন্নতা। কৃত্রিমতা ও প্যাকেটজাত খাবার এড়িয়ে নিজের ও প্রিয়জনদের পাতে তুলে দিতে চাইছে প্রাকৃতিক কিছু। এখন মানুষের মধ্যে সচেতনতা আগের তুলনায় বেড়েছে। খাঁটি ও প্রাকৃতিক খাবারের সন্ধানে মানুষ ছুটে যাচ্ছে ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোয়। খুঁজে নিয়ে আসছে প্রাকৃতিক, ভেজাল ও বিষমুক্ত খাবার। অনেক ব্যবসায়ী ঢাকায় বসেই ভেজাল ও বিষমুক্ত খাবার মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছেন। বিশেষত অনলাইনের এ যুগে ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছেন নিরাপদ খাবার। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন অনেক স্টার্টআপ, নতুন প্লাটফর্ম।

২০১৫ সালের মার্চে এমনই একটি উদ্যোগ নেন কয়েকজন তরুণ। সদ্য লেখাপড়া শেষ করা এসব তরুণ চাকরির সন্ধানে না গিয়ে শুরু করেন কৃষিকাজ। গড়ে তোলেন ‘গ্রিনারি এগ্রো’ নামে ভিন্নধর্মী একটি খামার। স্বপ্ন ছিল শহরবাসীকে প্রাকৃতিক, ভেজাল ও বিষমুক্ত খাবার সরবরাহ করা; রাজধানীর যান্ত্রিক পরিবেশ থেকে মানুষকে কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি দিয়ে গ্রামীণ পরিবেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। চার বছরের ব্যবধানে তাদের এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। প্রায় পুঁজিহীন অবস্থান শুরু করে বর্তমানে গ্রিনারি এগ্রোর খামারের আয়তন দাঁড়িয়েছে ১০ একরে।

ঢাকার অদূরেই কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া গ্রামে গ্রিনারি এগ্রোর খামার। ঢুকতেই চোখে পড়বে বিশাল কয়েকটি পুকুর। এসব পুকুরে চাষ হচ্ছে মাছ। মাছের খাবারে কোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার হয় না বলে জানালেন খামারিরা। এমনকি হাঁস-মুরগিকেও নিরাপদ খাবার খাওয়ানো হয়। ফলে খামারটিতে উৎপাদিত ডিমও বিষমুক্ত। পাশেই রয়েছে সবজিক্ষেত। মৌসুমভেদে শাক ও সবজি ফলানো হয় এখানে। আরো উৎপাদন হয় মৌসুমি ধান ও গম। রয়েছে দেশীয় ফলের সমাহার। আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, ডাব কী নেই এখানে।

কথা হচ্ছিল গ্রিনারি এগ্রোর উদ্যোক্তাদের একজন কামরুল হাসান মিথুনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ২০১৫ সালে মাত্র ৫০০ টাকায় পরিচিত একজনের পুকুরের পাশের জমি ইজারা নিয়ে তুলসী গাছ লাগানোর মধ্য দিয়ে এ উদ্যোগের শুরু। পুঁজি বলতে ছিল অদম্য ইচ্ছা, ভালো কিছু করার স্বপ্ন আর হাড়ভাঙা পরিশ্রম। বর্তমানে ১০ একর জমিতে খামারটির বিস্তৃতি ঘটেছে। মাছ চাষের জন্য রয়েছে পাঁচটি পুকুর। জমি, পুকুর সবই ইজারা নেয়া। বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ১০ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে।

খামারটির বিপণনের দায়িত্বে থাকা কামরুল হাসান মিথুন বলেন, শহুরে যান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত মানুষ সময় পেলেই একটু স্বস্তি খুঁজে ফেরে। অনেকেই আছেন যারা জীবন ও জীবিকার তাগিদে গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন। কিন্তু আর গ্রামে ফিরতে পারছেন না। তাদের জন্যই গ্রিনারি এগ্রো। সপ্তাহ শেষের ছুটির দিনে এখানে যে কেউ চলে আসতে পারেন। গ্রামীণ আবহ পাবেন। নিজেরাই কৃষিকাজে অংশ নিতে পারবেন। ফসল লাগাবেন, ক্ষেত থেকে নিজ হাতে শাক ও সবজি তুলবেন। মাছ ধরবেন, গাছ থেকে ফল পাড়বেন। ফেরার সময় সেই ফসল, মাছ, ফল, সবজি স্বল্পমূল্যে কিনে নিয়ে যেতে পারবেন।

স্থানীয়দের পাশাপাশি রাজধানী থেকে প্রাণের টানে ছুটে যাওয়া এসব মানুষই গ্রিনারি এগ্রোর প্রধান ক্রেতা। এখানে যেকোনো শাক আঁটিপ্রতি ৩০ টাকায় পাওয়া যায়। সবজি মিলবে আইটেমভেদে ৪০-৫০ টাকা কেজিতে। মাছ পাওয়া যাবে আকারভেদে ৪০০-৪৫০ টাকা কেজির মধ্যেই।

গ্রিনারি এগ্রোর উদ্যোক্তাদের আরেকজন মাহফুজ রশীদ। তিনি প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষিপণ্য উৎপাদনের পেছনে পুরোটা সময় ব্যয় করছেন। তিনি জানান, গ্রিনারি এগ্রো শুরু থেকেই একটি নিয়ম মেনে চলছে। তা হলো, প্রকৃতির ওপর জোর খাটানো চলবে না। প্রাকৃতিক উপায়ে ও জমির উর্বরাশক্তি কাজে লাগিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এ কারণে গ্রিনারি এগ্রোতে নাইট্রোজেন চক্র রক্ষায় সহায়ক এমন গাছ লাগানো হয়েছে। জমির আর্দ্রতা ধরে রাখা, অণুজীব রক্ষা, আগাছা নিয়ন্ত্রণে প্রাকৃতিক উপায় মেনে চলায় বিশেষ জোর দেয়া হয়। ব্যবহার করা হয় জৈব সার। কোনো ধরনের রাসায়নিকের ব্যবহার হয় না।

তিনি বলেন, আপনি যখন মাটির ওপর জোর খাটাবেন না, মাটিকে অত্যাচার করবেন না, তখন মাটিও আপনাকে দ্বিগুণ উৎপাদন ফেরত দেবে। এ কারণে গ্রিনারি এগ্রোতে উৎপাদন বেশি হয়। এক জমিতে একাধিক ফসল ফলানো যায় এবং উৎপাদিত ফসল, মাছ, শাক-সবজি, ফল পুরোপুরি রাসায়নিকমুক্ত ও প্রাকৃতিক।

গ্রিনারি এগ্রোর যাত্রা এতটা মসৃণ ছিল না। কামরুল হাসান মিথুন জানালেন, শুরুতে স্থানীয়রা অবিশ্বাসের চোখে দেখত। তাদের ধারণা ছিল, পড়াশোনা জানা ছেলেরা ঝোঁকের বশে কৃষিতে এসেছে। ঝোঁক কেটে গেলে তারা চাকরিতে ফিরে যাবে। তবে এখন তাদের মধ্যে এ ধরনের চিন্তাভাবনা আর নেই। খামারের সফলতার সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে আশপাশের পরিবেশও। অনেকেই কৃষিকাজে আগ্রহী হয়ে উঠছে। গ্রিনারি এগ্রো এখন পর্যন্ত ১২ জন শিক্ষিত তরুণকে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাদের দেখে নতুন করে আরো পাঁচটি খামার তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, শুরুতে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল অভিজ্ঞতার অভাব। আমাদের স্বপ্ন ছিল, উদ্যম ছিল। তবে পকেটে পয়সা আর কৃষিকাজের জন্য মাথায় বুদ্ধি ছিল না। ওই সময় গ্রামের মুরব্বিদের পরামর্শ খুব কাজে দিয়েছে। তাদের পরামর্শ মেনে কৃষিপণ্য উৎপাদন করতাম। সরকারি ঋণ কিংবা সহায়তা চেয়েও পাইনি। তবে এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। প্রাকৃতিক কৃষি নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে। অভিজ্ঞতা হয়েছে। উৎপাদন বেড়েছে।

কামরুল হাসান মিথুনের কাছে প্রশ্ন ছিল, আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? তিনি বললেন, ভেজাল ও বিষযুক্ত খাবারে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। এতে খাবার কিনতে মানুষের ব্যয় যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়তি অর্থ খরচ হচ্ছে চিকিৎসায়। আমরা চাই না, মানুষ ভেজাল ও বিষযুক্ত খাবারে অভ্যস্ত হোক। হাসপাতালগুলোয় বাড়তি টাকা খরচ করুক। তাই নিরাপদ খাবারের জোগান দেয়া আমাদের মূল লক্ষ্য।

একই সঙ্গে দেশজুড়ে নিরাপদ খাবারের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা, নেটওয়ার্ক তৈরি করা গ্রিনারি এগ্রোর অন্যতম লক্ষ্য। এতে একদিকে যেমন নিরাপদ খাবারের ক্রেতা বাড়বে, তেমনি অনেক ক্রেতা নিজেরাই উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবেন। পাশাপাশি কেরানীগঞ্জের খামার ঘিরে কৃষিভিত্তিক পর্যটন গড়ে তোলার স্বপ্ন রয়েছে। এতে শহুরে যান্ত্রিকতায় বিরক্ত হলে যে কেউ এখানে গিয়ে কিছু সময়ের জন্য হলেও প্রশান্তি খুঁজে পাবেন। গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক পরিবেশে নিজেকে প্রাণবন্ত করে ফিরে আসতে পারবেন।সূত্র-বনিক বার্তা