মঙ্গলবার রাতে র‌্যাব-১১ সদস্যরা অভিযান চালিয়ে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার সোনাকান্দা এলাকা থেকে এক নারী সদস্যসহ জেএমবির তিন জঙ্গী সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হলো- জান্নাতুল নাঈম ওরফে মিতু (১৯), মেহেদী হাসান ওরফে মাসুদ (২২) ও আকবর হোসেন সুমন (৩০)।এ সময় মিতুর ২ বছরের শিশু রোজাকেও উদ্ধার করা হয়। বুধবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজীনগর এলাকায় অবস্থিত র‌্যাব-১১ এর প্রধান কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেনেন্ট কর্ণেল কামরুল হাসান এ তথ্য জানান।
র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল কামরুল হাসান জানান, গত ২ এপ্রিল সোনারগাঁয়ের নুরুল ইসলাম তার মেয়ের জামাই জুয়েলকে সঙ্গে নিয়ে র‌্যাব-১১ কার্যালয়ে এসে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন যে, তার মেয়ে মিতু জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং সে রাষ্ট্র বিরোধী ও নাশকতামূলক কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়ার জন্য তার দুই বছরের শিশু সন্তান রোজা আক্তারসহ চলতি বছরের ৩১ মার্চে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

তারা দ্রুত তাকে আইনের আওতায় আনার জন্য অনুরোধ জানায়। এর প্রেক্ষিতেই র‌্যাব-১১ সদস্যরা মঙ্গলবার রাতে সোনাকান্দা এলাকা থেকে মিতুসহ জেএমবির তিন জঙ্গী সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি আরও জানান, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে গ্রেফতারকৃত জান্নাতুল নাঈম মিতুর ফেইসবুক আইডির মাধ্যমে মেহেদী হাসান মাসুদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মেহেদী তাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে কাজ করার আহবান জানিয়ে জসিম উদ্দিন রাহমানির উগ্রবাদী বক্তব্য সম্বলিত বিভিন্ন বক্তব্য সরবরাহ করে।

এ প্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে সে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হলে তাকে জেএমবির দাওয়াত দেয়। এছাড়াও নামায আদায় না করলে ও দাঁড়ি না রাখলে তার স্বামীকে পরিত্যাগ করা উচিত বলে বিভিন্ন ফতোয়া প্রদান করে। মেহেদী হাসান তাকে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হওয়ার আহবান জানালে মিতু তাতে সাড়া দেয়। এরপর থেকে মিতু তার ফেইসবুক আইডিতে বিভিন্ন যুদ্ধ, অস্ত্র ও গোলাবারুদের স্থিরচিত্র এবং ভিডিওসহ বিভিন্ন উগ্রবাদী মতবাদ প্রচার করতে থাকে। মিতু তার স্বামী জুয়েলকে উগ্রবাদের পথে আসার আহবান জানিয়ে ব্যর্থ হলে স্বামীকে ত্যাগ করে কথিত শহীদি মৃত্যু বরণ করার লক্ষ্যে হিযরত করার পরিকল্পনা করে।

এরপর মেহেদী তার বন্ধু আকবর হোসেন সুমনের সঙ্গে মিতুর যোগাযোগ করিয়ে দেয়। সুমন ও মেহেদীর পরামর্শ অনুযায়ী মিতু চলতি বছরের ৩১ মার্চ সোনারগাঁয়ের তার নিজ বাড়ি থেকে চট্টগ্রামে চলে যায়। সুমন ও মেহেদী তাকে সেখানে একটি ভাড়া বাসা ঠিক করে দেয়। তারা দু’জনে মিতুকে শহীদ হওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরণের কৌশল ও পরামর্শ প্রদান করে এবং মিতুকে শহীদি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে।
পরে তারা নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও ঢাকার কয়েকজন জেএমবি সদস্যের সাথে যোগাযোগ করে সংগঠনের কর্মী সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সফরের পরিকল্পনা নেয়। এ লক্ষেই তারা নারায়ণগঞ্জে একত্রিত হয়েছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।

র‌্যাব-১১ অধিনায়ক আরো জানান, মেহেদী হাসান ২০১৫ সালে সামির মাধ্যমে হানাফি থেকে সালাফি মতাদর্শে দীক্ষিত হয়। এরপর উক্ত সামি ভাই তাকে উগ্রবাদী বিভিন্ন বয়ান শুনতে ও কিছু বই পড়তে দেয়। পরবর্তীতে এ সকল বয়ান ও বইয়ের মাধ্যমে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়ে সে বিভিন্ন সালাফি মসজিদে যাতায়াত শুরু করে। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে মেহেদী দাওয়াতী কাজে ব্যাপকভাবে তৎপর ছিল। এসময়ে সে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় সফর করে জেএমবির কর্মী সংগ্রহ করেছে।

২০১৮ সালে সে কয়েকবার নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও সোনারগাঁয়ে সফর করে বিভিন্ন গোপন মিটিং ও জেএমবির কর্মী সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রেখেছিল। সে বিভিন্ন সময়ে দ্বীনি বোনদেরকে পর্দার আড়াল থেকে জেএমবির আদর্শিক বয়ান প্রদান করত এবং বাংলার মাটিতে জিহাদ কায়েম করার জন্য একনিষ্ঠভাবে ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানাত। এর সুবাদে একাধিকবার মিতুর সাথে সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন জায়গায় মেহেদীর দেখা হয়। মেহেদী সরাসরি দাওয়াতী কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও উগ্রবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করত।

র‌্যাব আরও জানায়, গ্রেফতারকৃত আকবর হোসেন সুমনের চাকুরীর সুবাধে মেহেদী হাসানের সঙ্গে পরিচয় হয় । মাসুদ সুমনকে উগ্রবাদের দাওয়াত দেয় এবং তাকে বিভিন্ন উগ্রবাদী বই পড়তে ও উগ্রবাদী বয়ান শুনতে বলে। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা দিতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সুমন জেএমবির সাথে জড়িয়ে পড়ে। এরপর সুমন এবং মেহেদী একত্রে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করে সংগঠনের সদস্য সংগ্রহের কাজ করে।

সুমন বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ পুলিশ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের উস্কানীমূলক বক্তব্য ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করে সকলকে জঙ্গী কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করত। মেহেদীর মাধ্যমে মিতুর সঙ্গে সুমনের পরিচয় হয়। সুমন মিতুকে হিযরত করে শহীদি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন প্রকার অপব্যাখ্যা প্রদান করে।
আকবর হোসেন সুমন এ পর্যন্ত একাধিক নারীসহ ১০-১২ জনকে জেএমবির আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে সংগঠনে অন্তর্ভূক্ত করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে র‍্যাব জানায়।