নদীভাঙন প্রতিরোধে বালির বস্তা ও ব্লকের ব্যবহার হয়ে এসেছে এতদিন। এর পরিবর্তে বর্তমানে ‘বাঁশের বেড়া’ ব্যবহার করে নদীভাঙন ঠেকানোর কথা ভাবছে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ড. লুত্ফর রহমান উদ্ভাবিত এ পদ্ধতি বালির বস্তা ও ব্লকের তুলনায় আরো কার্যকর ও ব্যয়সাশ্রয়ী বলে দাবি করছে ইনস্টিটিউট। বলা হচ্ছে, এ পদ্ধতি ব্যবহার করে একদিক থেকে যেমন নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা যাবে, তেমনি পুনরুদ্ধার হবে নদীর তীরবর্তী জমিও।

বিভিন্ন সংস্থার হিসাব বলছে, ভাঙনের কারণে প্রতি বছর নদীগর্ভে চলে যায় প্রায় ২৫ হাজার একর জমি। ভাঙন ঠেকাতে সাধারণত বালির বস্তা ও ব্লকের ব্যবহার হয়ে থাকে। এর তুলনায় ব্যয়সাশ্রয়ী ও কার্যকর পদ্ধতি প্রয়োগের উপযোগিতা থেকেই উদ্ভাবন হয়েছে বাঁশের বেড়া ব্যবহারের পদ্ধতি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সহজলভ্য উপকরণ ব্যবহার করে প্রয়োগকৃত এ পদ্ধতির কার্যকারিতা যাচাইয়ে বর্তমানে রাজবাড়ীর চর সেলিমপুর এলাকায় পরীক্ষামূলক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ইনস্টিটিউট। এর আগে জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, বরিশালসহ নদীভাঙন প্রতিরোধে একই ধরনের পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

বাঁশের বেড়া বা ব্যান্ডেলিং পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে, জানতে চাইলে এর উদ্ভাবক ড. লুত্ফর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, এজন্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বাঁশ দিয়ে একটি বিশেষ ব্যান্ডেল (বেড়া) বানানো হয়। এ ব্যান্ডেলের ওপরের অংশ বাঁশের চাটাই দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। আর নিচের অংশ খোলা রাখা হয়। নদীতে যেদিকে পানির প্রবাহ থাকে, সেদিকের সঙ্গে অ্যাঙ্গেল (কৌণিক) করে তীরে স্থাপন করা হয়। নদীর প্রবাহিত পানি ব্যান্ডেলের ওপরের অংশের চাটাইয়ে আঘাত পেয়ে মূল নদীর দিকে চলে যায়। একই সঙ্গে নিচের পলি বা বালি মাটির মিশ্রিত অংশ ব্যান্ডেলের চাটাইয়ের নিচ দিয়ে নদীতীরে চলে আসে। এটি আস্তে আস্তে জমা হয়ে তীরের ভূমি পুনরুদ্ধার হতে থাকে। সাধারণত যেসব জায়গায় নদী তীর বেশি ভাঙে, সেসব জায়গার উজানে বাঁশের ব্যান্ডেল তৈরি করে নদীর তীর ভাঙন রোধ করা সম্ভব।

ভাঙন রোধের পাশাপাশি পদ্ধতিটি নদীর গভীরতা বৃদ্ধিতেও সক্ষম বলে জানান ড. লুত্ফর রহমান। তিনি বলেন, সাধারণত নদীর মাঝ বরাবর পরিষ্কার পানি প্রবাহিত হয়। বিভিন্ন জায়গায় বাধা পেয়ে এ পানির স্রোত তীরের দিকে ধেয়ে যায়। এর ফলেই ভাঙন দেখা দেয়। অন্যদিকে তীর বরাবর প্রবাহিত হয় পলি বা বালিমিশ্রিত পানি। এ অবস্থায় নদীর মূল স্রোতকে যদি তীরে ঘেঁষতে না দেয়া হয়, তাহলে মূল স্রোতটি নদীর ‘বেড’ ক্ষয় করা শুরু করে। স্বভাবতই তখন নদীর গভীরতা বাড়তে শুরু করে। বাঁশের ব্যান্ডেলিং দিয়ে মূল স্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করে নদীর নাব্যতাও বৃদ্ধি করা যাবে।

তিনি আরো জানান, এ পদ্ধতি বালির বস্তা বা সিমেন্টের ব্লকের তুলনায় অনেক ব্যয়সাশ্রয়ী। এগুলো নির্মাণে ব্যবহূত উপকরণ (ইট, বালি, খোয়া, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি) বেশ ব্যয়বহুল। এর বদলে বাঁশ, লোহার পেরেক ও তার দিয়েই বেড়া বানিয়ে ফেলা সম্ভব। বালির বস্তা বা সিমেন্টের ব্লকের তুলনায় বাঁশের বেড়ায় খরচ কয়েক গুণ কম। আবার বাঁশের বেড়ার কথা শুনে অনেকের মনে হতে পারে, এটি বোধ হয় খুব বেশিদিন টিকবে না। আসলে বিষয়টি এমন নয়। সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে একটি বেড়া দিয়ে সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত সুবিধা পাওয়া সম্ভব।

এর আগে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে যমুনা নদীর চর পেঁচাখোলার উজানে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে সাফল্য পাওয়া গেছে। বর্তমানে রাজবাড়ীতে পদ্মার চর সেলিমপুর এলাকায় এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ভাঙন রোধ নিয়ে আরেকটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প চলমান রয়েছে। এতে ব্যয় হচ্ছে ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। বাঁশের বেড়া দিয়ে ভাঙন রোধের কাজটি করছে ‘ভাওয়াল কনস্ট্রাকশন’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ‘রিভার ব্যাংক প্রটেকশন ইউজিং ব্যাম্বো ব্যান্ডেলিং স্ট্রাকচার্স ইন দ্য পদ্মা রিভার নিয়ার চর সেলিমপুর অ্যান্ড অ্যারাউন্ড দ্য রাজবাড়ী টাউন’ শীর্ষক প্রকল্পটির পরিচালক হিসেবে রয়েছে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কাজী রেজাউল করিম। প্রকল্পটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চর সেলিমপুরের প্রকল্পটি পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দরপত্রসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ। শিগগির মূল কাজ শুরু করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

তিনি আরো বলেন, আমি যতদূর জানি, এটাই বোধ হয় শেষ পরীক্ষামূলক প্রকল্প। এরপর আর পরীক্ষামূলক নয়, পূর্ণাঙ্গ হিসেবেই বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। তবে তা পরীক্ষামূলক প্রকল্পগুলোর ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন নদীর ১১-১২টি পয়েন্টে বাঁশের বেড়া পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে দুয়েকটি ছাড়া বাদবাকি সবখানেই সাফল্য এসেছে। আশা করছি, পদ্ধতিটি দেশে নদীভাঙন রোধে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।সূত্র-বনিক বার্তা