আমাদের দৈনন্দিন অসুখ নিয়ে ভোগান্তির মধ্যে ‘অ্যাসিডিটি’ এখন সবথেকে বেশি চর্চিত বিষয়। বর্তমানে অ্যাসিডিটি বা গ্যাস অম্বলে ভোগেন না— এরকম মানুষের সংখ্যা খুবই কম। পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তের লোকেরাই এই রোগের শিকার। যাঁরা শীত-প্রধান এলাকায় বসবাস করেন; তাঁদের তুলনায় গ্রীষ্ম প্রধান এলাকার মানুষজন বেশি অ্যাসিডিটিতে ভোগেন।
সমগ্র পৃথিবীর প্রায় পঞ্চাশ-ষাট শতাংশ মানুষ অ্যাসিডিটিতে ভোগেন। ছোট শিশু থেকে বয়স্ক— সবাই। তবে মাঝবয়সিরা সব থেকে বেশি কষ্ট পান। আবার দেখা গিয়েছে ধূমপায়ী ও মদ্যপায়ীদের কুঅভ্যেসের জন্য মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা অপেক্ষাকৃত বেশি কষ্ট পান।
অ্যাসিডিটি আসলে কী?
আমরা যখন খাদ্য খাই— খাদ্যনালী বা ইসোফেগাসের মধ্যে দিয়ে ওই খাবার পাকস্থলীতে নেমে আসে। এবং পাকস্থলীতে নিঃসৃত অ্যাসিড এইচসিএল বা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের মাধ্যমে এই খাবার ভেঙে যায়। কোনও ব্যক্তির শরীরে খাদ্য ভিত্তিক কতটা অ্যাসিড প্রয়োজন— সেটা আমাদের ব্রেন নার্ভ নিয়ন্ত্রণ করে। আবার নার্ভের মাধ্যমে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিয়ন্ত্রণ হয়— সেটা হল অ্যাসিডের প্রবাহ বা ফ্লো। অর্থাৎ পাকস্থলী ও খাদ্যনালীর সংযোগস্থলের পেশির সংকোচন-প্রসারণকে প্রয়োজনভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। যার ফলে পাকস্থলী থেকে অতিরিক্ত অ্যাসিড খাদ্যনালীতে পৌঁছাতে পারে না। কিন্তু, যদি এই অ্যাসিডের গতি-প্রবাহ বা ফ্লো এবং ক্ষরণ মাত্রা বা অ্যাসিড সিক্রেশন ঠিকমতো নিয়ন্ত্রিত না হয়, আমরা অ্যাসিডিটি বা গ্যাস-অম্বলে ভুগতে থাকি।
মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিডিটি কেন হয়?
আমরা যতই আধুনিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, ততই, অ্যাসিডিটির প্রকোপ ক্রমশ এত শক্তিশালী আকার ধারণ করছে যে, অনেক সময় ওষুধ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। একেই বলা হচ্ছে হাইপার অ্যাসিডিটি।
হাইপার অ্যাসিডিটির কারণ
অনেক কারণে এই রোগ হয়। অন্যতম বড় কারণ ওভার ইনডালজেন্স বা পরিপাক ক্রিয়ার ওপর চাপ। খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে আমাদের খাদ্যাভ্যাস। আমরা ক্রমশ হালকা সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাদ্যের পরিসীমার বাইরে চলে যাচ্ছি।
জাঙ্ক ফুড, ফাস্ট ফুড, কেমিক্যাল দেওয়া প্রসেসড ফুড আমাদের খাদ্যতালিকা দখল করে নিয়েছে। আর এই কারণে আমাদের পরিপাকতন্ত্রের উপর চাপ বাড়ছে। এছাড়া বেশি খেয়ে ফেলার সমস্যাও রয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা আত্মতৃপ্তির সীমাটা বোঝেন না। আমাদের বাঁচতে হবে; তাই খেতে হয়। খাদ্য থেকে যে শক্তি মেলে তা দিয়ে সুস্থ শরীরে দৈনিক ক্রিয়াকর্মগুলো ঠিক ঠিকভাবে পালন করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। সেই জায়গায় অতিরিক্ত খাদ্য খেলে অ্যাসিডিটি থেকে আমরা কখনওই মুক্তি পাব না।
আর একটি বড় কারণ হল স্ট্রেস বা মানসিক চাপ। আমরা এখন কম-বেশি সবাই মানসিক চাপের শিকার। আর এই চাপ আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে ঠিকমতো কাজ করতে দেয় না। পরিণামে, আমাদের পরিপাক ক্রিয়াও ঠিকমতো সম্পন্ন হয় না।
এছাড়াও কিছু কিছু ওষুধের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আমরা বেশি অ্যাসিডিটিতে কষ্ট পাই।
হাইপার অ্যাসিডিটির লক্ষণ
আমাদের সবার ক্ষেত্রে লক্ষণ একরকম নাও হতে পারে। তবে সাধারণত যে লক্ষণগুলো থাকে সেগুলো হল— পেট ফেঁপে থাকা। বিরক্তিকরভাবে ঘন ঘন ঢেকুর ওঠে। পেটের মধ্যে রাম্বলিং বা অনিয়মিত গ্যাসের গতি অনুভব করা।
বুকজ্বালা একটা বড় লক্ষণ। কারও কারও ক্ষেত্রে সবসময় একটা বমি বমি ভাব। অনেকের ক্ষেত্রে খিদে কমে যাওয়া, কেউ আবার বুকে-পেটে-পিঠে ব্যথা অনুভব করেন। শরীরে অস্বস্তি এবং অস্থিরতা দেখা যায়।
আবার অনেক সময় বেশ কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণও দেখা যায়। যেমন—সমগ্র শরীরের মধ্যে একটা ঝিমুনি ভাব। অনেকে আবার হাইপার অ্যাসিডিটিতে অচেতনও হয়ে পড়েন। যদিও খুব কম ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে থাকে।
হাইপার অ্যাসিডিটিতে কোন কোন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত!
কিছু কিছু খাদ্য আছে যেগুলি আমাদের পরিপাকতন্ত্রের ক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটায় এবং অ্যাসিডিটি বা গ্যাস অম্ল বেশি হয়। যেমন—
বেশি লঙ্কা বা বেশি ক্যাপসিসিন, পেঁয়াজ, রসুন, বেশি সরষে, বাঁধাকপি, টম্যাটো, বেশি টক জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাদ্য, চর্বি জাতীয় বা ফ্যাটি ফুড; হোল-গ্রেন ব্রেড বা পাউরুটি প্রভৃতি। প্লুটেন— ইনটলারেন্স থাকলে, আটার রুটি থেকেও নিজেকে সরিয়ে রাখুন।
ঘরোয়া ব্যবস্থা—
হঠাৎ অ্যাসিডিটির ক্ষেত্রে আপনি কিছু ঘরোয়া ব্যবস্থা নিতে পারেন। হাতের সামনে বেকিং-সোডা থাকলে. সেটাও জলে গুলে নিতে পারেন।
এবার কিন্তু কয়েকটা জিনিস মাথায় রাখা বা খেয়াল করা দরকার।
 পেটের উপর চাপ পড়ে এমন ক্রিয়াকর্মগুলো কমিয়ে দিন।
 টাইট জামা-কাপড় যা পেটের উপর চাপ দেয় এড়িয়ে চলুন।
 দুটো খাবার খাওয়ার মধ্যে একটু গ্যাপ রাখুন।
 আবার একই সঙ্গে অনেকটা খাবার না খেয়ে অল্প অল্প করে বার বার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
 খুব বেশি রাত জাগা কমিয়ে দিন।
 ঘুমানোর সময় মাথা একটু শরীরের লেভেলের উপরে রাখুন।
 শেষে বলব— খাবার তৃপ্তি করে খান, উপভোগ করুন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনও খাবার খাবেন না। উন্নয়নশীল সভ্যতায় ব্যস্ততা থাকবেই; তবুও হাতে সময় নিয়ে খাবার খাবেন।
 মানসিক চাপ কমিয়ে ফেলুন।
চিকিৎসা পদ্ধতি
হাইপার অ্যাসিডিটির যে কোনও চিকিৎসা পদ্ধতিই গ্রহণ করা যায়। তবে দীর্ঘস্থায়ী অ্যাসিডিটির জন্য হোমিওপ্যাথি একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে। লক্ষণভিত্তিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার মাধ্যমে আমাদের শরীরের পরিপাকতন্ত্রের ক্রিয়াকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।
তবে অ্যাসিডিটির পেছনে অন্য বড় কোনও কারণ আছে কি না, সেটা কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখে নেওয়া প্রয়োজন। সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি নিয়মিত হালকা শরীর-চর্চার প্রয়োজন। ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ, বোন, মেডিটেশন প্রভৃতি পরোক্ষভাবে এই রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
সবশেষে বলব— শুধু মানব শরীর নয়, পৃথিবীর অনেক মহাসাগরের জলও ক্রমশ অ্যাসিডিক হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিতে বৃষ্টির জলে অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ছে।
তাই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের রোগ ভোগান্তিও বাড়তে থাকবে। কিন্তু আপনার সঠিক সচেতনতা ও যত্ন আপনাকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে।
সূত্র-বর্তমান