১৩ বছর বয়সী নিকা সেলিভানোভা তার দুই হাত দিয়ে হার্টের আকৃতি তৈরি করে প্রিয় বন্ধু ইনার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। খেরসন ট্রেন স্টেশনে ঢোকার হলঘর আর মানুষের অপেক্ষার জায়গার মাঝখানে যে কাঁচের দেয়াল, তার দুই দিকে দুজন। ইনা কাঁচের দেয়ালে মুখ ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে নিকার দিকে।

এর কয়েক মূহূর্ত আগে দুজন যখন দুজনকে আলিঙ্গন করছিল, তখন দুজনের চোখেই টলমল করছিল অশ্রু। নিকার কোলে তার পোষা কুকুর, একটি কম্বলে জড়ানো। ইনা সেটিকে চুমু দিল। এই দুজন জানে না, আবার কবে তাদের দেখা হবে।

নিকার পরিবার খেরসন ছেড়ে পালাচ্ছে। তারা জানে না, কোথায় তাদের শেষ পর্যন্ত আশ্রয় মিলবে। তবে আপাতত তারা পশ্চিমের শহর খমেলনিটস্কির দিকে যাচ্ছে, আশা করছে সেখানে কিছু সাহায্য নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

গত কদিন ধরে খেরসনের যে পরিস্থিতি, সেটি নিকা’র মা এলেনা আর কিছুতেই নিতে পারছিলেন না।

“আগে রুশ বাহিনী আমাদের ওপর দিনে সাত হতে দশবার গোলা দাগতো, আর এখন দিনে ৭০-৮০ বার, সারাদিন। অবস্থা খুবই ভীতিকর”, বলছিলেন এলেনা। “আমি ইউক্রেনকে ভালোবাসি, আমার শহরকে ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের চলে যেতে হচ্ছে।”

ক্রিসমাসের দিন হতে যে প্রায় চারশো জন মানুষ খেরসন ছেড়ে পালিয়েছে, এলেনা এবং তার তিন মেয়েও আছেন তাদের মধ্যে। রুশ বাহিনী খেরসনের ওপর গোলাবর্ষণ অনেক বাড়িয়ে দেয়ার পর তারা শহর ছাড়তে বাধ্য হন।

মঙ্গলবার একটি হাসপাতাল ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডে গোলা পড়েছিল। কেউ আহত হয়নি, কিন্তু এরপর মানুষের মধ্যে আতংক আরও বেড়েছে।

এলেনা ট্রেনে চেপে খেরসন ছেড়েছেন। ইউক্রেনের সরকারের সহায়তায় এই উদ্ধার অভিযান চালানো হয়।

শত শত মানুষ অবশ্য নিজের ব্যবস্থাতেই পালাচ্ছেন। খেরসন থেকে বেরুনোর পথে যে চেকপয়েন্ট, সেখানে গাড়ির দীর্ঘ লাইন। গাড়ির ভেতরে আতংকগ্রস্ত বেসামরিক মানুষ।

আমরা যখন ইরিনা আন্তোনেনকোর সঙ্গে কথা বলতে তার গাড়ির কাছে যাই, তখন তিনি কাঁদছিলেন।

“আমরা আর নিতে পারছি না। ওরা তীব্র গোলাবর্ষণ করছে। আমরা এতদিন থেকে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এক সময় থামবে, ভাগ্য ভালো হলে আমরা বেঁচে যাব। কিন্তু আমাদের পরের বাড়িটাতেই গোলা এসে পড়েছে। আমার বাবার বাড়িতেও গোলার আঘাত লেগেছে”, বলছিলেন তিনি।

ইরিনা ইউক্রেনের মধ্যাঞ্চলের একটি শহর ক্রিভি রিহ শহরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, সেখানে তার পরিবারের অনেকে থাকেন।

মাত্র গতমাসেই খেরসনে বেশ আনন্দ-উল্লাসের চিত্র দেখা গিয়েছিল। ইউক্রেন অভিযানের দ্বিতীয় দিনেই রাশিয়া খেরসন দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু ১১ নভেম্বর ইউক্রেনের বাহিনী এই শহর মুক্ত করে।

রাশিয়ার দখলমুক্ত হওয়ার পর শহরের কেন্দ্রস্থলে যে জায়গাটিতে জনতা ইউক্রেনের পতাকা দুলিয়ে উল্লাস করেছিল, সেখানে ক্রিসমাসের আগের দিন একটি মর্টার হামলা হয়, তাতে নিহত হন ১১ জন।

নিহতদের মধ্যে ছিলেন একজন সমাজ কর্মী, একজন কসাই এবং মোবাইল ফোনের সিম কার্ড বিক্রি করতেন এরকম এক নারী। এরা সবাই সাধারণ মানুষ, যারা শহরের কেন্দ্রে বাজারে এসেছিলেন। ইউক্রেনের সরকার বলছে, সেদিন খেরসনে ৪১ বার মর্টার হামলা হয়।

রুশরা খেরসনের ওপর হামলা চালাচ্ছে নিপ্রো নদীর পূর্ব তীর থেকে, খেরসন ছাড়ার পর যেখানে তারা অবস্থান নিয়েছে। নদীটি এখন কার্যত দুই পক্ষের যুদ্ধরেখা হিসেবে কাজ করছে।

খেরসন কৌশলগতভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ শহর, এটিকে ক্রাইমিয়ার প্রবেশদ্বার বলে বর্ণনা করা হয়। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, রাশিয়াকে এই অঞ্চলে এখন রক্ষণাত্মক অবস্থান নিতে হচ্ছে।

খেরসনে এভাবে গোলাবর্ষণ করে রাশিয়া কী অর্জন করতে চায় তা বলা মুশকিল। মর্টার শেল ছাড়াও, আমরা এখানে আরও অনেক ধরণের ধ্বংসাত্মক বোমার ব্যবহার দেখেছি, লক্ষ্যবস্তুতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই যেন এরকম বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে।

ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী নদীর বাম তীরের দখল নিতে চায় কিনা, সেটাও পরিস্কার নয়।

মর্টার শেলের ক্রমাগত বিস্ফোরণের শব্দে যেন কোন বিরতি নেই।

সেরহি ব্রেশুন (৫৬) তার ঘুমের মধ্যেই নিহত হয়েছিলেন। গোলা এসে আঘাত করার পর তার ওপর বাড়িটি ধসে পড়েছিল।

সেরহি মারা যাওয়ার পরদিন আমরা তার মায়ের সঙ্গে দেখা করি। ৮২ বছর বয়স্ক তামারা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ছেলের পাসপোর্ট খুঁজতে এসেছিলেন। মর্গ থেকে লাশ নেয়ার জন্য ছেলের পাসপোর্ট তার দরকার ছিল।

“আমার মনে হচ্ছিল সেদিন খারাপ কিছু ঘটবে। কারণ আমি ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলাম, ওকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলছিলাম। কিন্তু ও যায়নি। সেখানেই সব শেষ হয়ে গেল। আমাদের জীবনটা শেষ হয়ে গেল”, কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন তামারা।

তামারা সঙ্গে আমাদের কথা শেষ হয়নি, এর মধ্যেই আরও বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। ছেলেকে সন্মানজনকভাবে বিদায় জানানোর জন্য এক বৃদ্ধা মায়ের এই একাকী চেষ্টা খুবই বিপদজনক, কারণ খেরসনের কোন অংশই এখন আর নিরাপদ নয়।

এই শহরের রাস্তায় বা ঘরের ভেতরে বেঁচে থাকাটা এখন একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার। রেডক্রসের ৩৯ বছর বয়স্ক স্বেচ্ছাসেবক ভিক্টোরিয়া ইয়ারিশকো তার সংস্থার খেরসন অফিসের বাইরে এক গোলা বিস্ফোরণে নিহত হন।

ভিক্টোরিয়া যেসব পদক পেয়েছিল, তার মা লুডমিলা বেরেঝনা সেগুলো আমাদের দেখাচ্ছিলেন।

“আমি খুবই খুশি যে ও অনেক মানুষকে সাহায্য করতে পেরেছিল। ও খুবই দয়ালু ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে এটি আমার জন্য খুবই বেদনাদায়ক। আমাকে শক্ত হতে হবে এবং ওর দুই সন্তানকে বড় করতে হবে। আমি ওদের বলি, মাকে নিয়ে ওরা গর্ব করতে পারে, ওদের মা ছিল এক সাহসী নারী।”

ভিক্টোরিয়া তার দুই সন্তানকে নিয়ে রেডক্রসের আন্ডারগ্রাউন্ড শেল্টারে থাকছিলেন। ১৭ বছরের আলিয়েনুশকা এবং ১২ বছরের সাশা এখনো সেখানেই থাকে। রেডক্রসের স্বেচ্ছাসেবকরাই এখন তাদের পরিবার হয়ে উঠেছে, তারাই এখন ভিক্টোরিয়ার দুই সন্তানকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, তাদের দেখাশোনা করছে।

“যখন এত কাছের কেউ মারা যায়, সেটা খুবই কষ্টের। কিন্তু আমরা যদি হাল ছেড়ে দেই, তাহলে তার মৃত্যু তো অর্থহীন হয়ে যাবে। আমরা কাজ করি, যাতে করে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। এটাই সবার আগে, আর সব কিছু এর পরে”, বলছিলেন ভিক্টোরিয়ার বন্ধু এবং আরেক স্বেচ্ছাসেবক দিমিত্রো রাকিটস্কি।

কিন্তু এই কাজ করার খুবই বিপদজনক, বিশেষ করে একথা জানার পর, যে নিজের পরিবারও প্রতি মূহুর্তে বিপদের মধ্যে আছে।

কয়েক মূহুর্ত পর যখন আরও কয়েকটি বোমা ফাটলো, দিমিত্রো পায়চারি করতে করতে করতে তার স্ত্রীকে ফোন করার চেষ্টা করছিলেন, তার মুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। তার দুটি সন্তান আছে।

“ওরা যেতে চায় না। ওরা আমাকে নিয়ে চিন্তা করে, আমি ওদের নিয়ে চিন্তা করি। এভাবেই আমরা বেঁচে আছি”, বলছেন তিনি।

“যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি ক্রুদ্ধ করে, সেটা হলো রুশ বাহিনী সবসময় বেসামরিক ঘর-বাড়ির ওপর হামলা করছে। বাড়িঘর, এপার্টমেন্ট, বয়লার রুম। এর যুক্তিটা আসলে কী, বোঝা মুশকিল,” বলছেন দিমিত্রো।

“আমাদের প্রায় কখনোই পানি বা বিদ্যুৎ থাকে না। কখনো অল্প সময়ের জন্য আসে, তারপর গোলাবর্ষণের কারণে আবার চলে যায়। রাতের বেলায় অবস্থা খুবই ভীতিকর। আমাদের এখনো গ্যাস আছে, ফলে আমরা ঘর গরম রাখতে পারি”, বলছিলেন লারিসা রেভটোভা নামের একজন বাসিন্দা।

খেরসনে এখনো হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ থাকে। কিন্তু আঞ্চলিক প্রশাসন এ সপ্তাহেই অন্তত দুবার তাদের শহর ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

বিরতিহীন এবং নির্বিচার গোলা হামলায় এই শহর সন্ত্রস্ত।