১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তাঁরই হাতেগড়া সেনাবাহিনী তাঁকে হত্যা করে। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত এবং সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্য রাতের আধারে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি আক্রমণ করে। ১৫ আগস্ট ফজরের আজানের পর একটানা গুলির আঘাতে বাড়টি প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুকে ঘুম থেকে জাগানো হয়। তিনি ঘুম থেকে ওঠেন এবং পরিস্থিতি বোঝার আগেই ঘাতকরা শেখ কামালকে গুলি করে হত্যা করে।

সেদিন ঘাতকেরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, আরিফ, বেবি ও সুকান্ত, আবদুল নাঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি।

‘বাংলদেশ রক্তের ঋণ’ এই বইটিতে সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকারনেহাস, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিবরণ লিখেছেন (পৃষ্ঠা ৮৮)। এতে উল্লেখ আছে, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের পরনে একটি ধূসর বর্ণের চেক লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি ছিল। ডান হাতে ছিল তাঁর ধূমপানের পাইপটি। মেজর মহিউদ্দিন, হুদা আর নূর বাড়ির প্রতিটি কামরা মুজিবের খোঁজে তন্ন তন্ন করে চষে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ অপ্রত্যাশতিভাবে মহিউদ্দিন মুজিবকে পেয়ে গেল। সে দুই তলায় উঠতে সিঁড়ির গোড়ায় পা ফেলতেই শেখ মুজিবকে দাঁড়ানো অবস্থায় দখেতে পায়। তাদের মধ্যে দূরত্ব ২০ ফুটের বেশি হবে না।’

‘শেখ মুজিবকে হত্যা করার দৃঢ় মনোবল নিয়ে অভিযানে বেরুলেও মহিউদ্দিন শেখ মুজিবুরের সামনে দাঁড়িয়ে পুরোপুরিভাবে মনোবল হারিয়ে ফেলে। মহিউদ্দিন আমতা আমতা করে তাঁকে বলেছিল, স্যার আপনি আসুন। তোমরা কি চাও? মুজিব অত্যান্ত কর্কশ ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বলেন, তোমরা কি আমাকে খুন করতে চাও? ভুলে যাও, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তা করতে পারেনি। তোমরা কি মনে করো তা করতে পারবে? পরে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে খুনি কর্ণেল ফারুক লেখক সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসাকারনেহাসকে বলেছিলেন, শেখ মুজিবুরের ব্যক্তত্বি ছিল অত্যন্ত প্রবল। মহিউদ্দিন তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে একেবারে নতজানু হয়ে পড়েছিল। ওই মুহূর্তে নূর চলে না আসলে কি যে ঘটত, তা আমার আন্দাজের বাইরে।’

‘মহিউদ্দিন তখন ওই একই কথা বলে চলছিল, স্যার, আপনি আসুন। আর অন্যদিকে শেখ মুজিব তাকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় ধমকিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় নূর এসে পড়ে। তার হাতে স্বয়ংক্রয়ি অস্ত্র। সে বুঝে ফেলে, শেখ মুজিবুর রহমান সময় কাটাতে চাইছেন। মহিউদ্দিনকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে নূর চিৎকার করে আবোল-তাবোল বলতে বলতে তার স্টেনগান থেকে মুজিবের প্রতি ব্রাশ ফায়ার করে। শেখ মুজিব তাকে কিছু বলার আর সুযোগ পেলেন না। স্টেনগানের গুলি তাঁর বুকের ডানদিকে একটি বিরাট ছিদ্র করে বেরিয়ে গেল। গুলির আঘাতে তাঁর দেহ মুখ থুবড়ে সিঁড়ির মাথায় পড়ে গেল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান নেতার প্রাণহীন দেহ সিঁড়ি দিয়ে কিছু দূর গড়িয়ে থেমে রইল। সময় তখন সকাল ৫টা ৪০ মিনিটি। বাঙালি জাতির সঙ্গে শেখ মুজিবের প্রচণ্ড ভাললোসার চিরতরে অবসান ঘটল।’

সকাল ৭টার বেতার সংবাদে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা বিবৃত হলো। সাথে সাথে সারা দেশে জারি হলো সামরকি আইন। মেজর ডালিম কিছুক্ষণ পর পর বঙ্গবন্ধুর হত্যার কথা ঘোষণা করতে লাগল। সমগ্র জাতি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।

জাতির এ কঠিন সময় হাল ধরার কেউ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরষিদকে বহিষ্কার করে খন্দকার মোস্তাক সেনাবাহিনীর হাত ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহন করে। দেশজুড়ে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এই সময় বিশ্বাসঘাতকতার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার অনেক মন্ত্রীই খন্দকার মোস্তাকের মন্ত্রীসভায় যোগ দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রনেতা ও বর্তমানে সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এদিকে সামরকি আইন অন্যদিকে গুম, হত্যা নিত্য ঘটনা ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার রাষ্ট্রপতি সায়েম এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান অধ্যাদশে জারি করে ঘোষণা দেয় : সভা, সমাবেশে, এবং সরকারি, বেসরকারি কোনো পর্যায়েই বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যাবে না। ভয়াবহ এ পরস্থিতিতে বাংলার মানুষ ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু দমে যায়নি। ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে এক মৌন মিছিল নিয়ে যায় এবং বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনেশোক প্রস্তাব উত্থাপন করে, যা সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ছিল খুবই জটিল এবং কঠিন।’

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ

বঙ্গবন্ধুর হত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়ে ময়মনসিংহের গোবিন্দপুর উপজেলার মুক্তাগাছার ছেলে, ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বজিৎ নন্দী অস্ত্রহাতে প্রতিবাদে নেমে পড়েন। সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর প্রতিরোধ বাহিনীতে যোগ দেন। ভারত সীমান্তবর্তী ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ডুমনি এলাকায় তাদের শিবিরগুলো ছিল। সেখানে হাজার হাজার যুবক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দেশের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। দেশব্যাপী বিছিন্নভাবে আক্রমণ চালান। এমনি একটি অপারেশন ছিল, ১৯৭৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে।

উল্লেখ্য যে, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা এলাকাটি ছিল বিশ্বজিৎ নন্দীর অধীন। অত্র এলাকায় বিশ্বজিৎ নন্দীর তত্ত্বাবধানে ছয়জন সশস্ত্র যোদ্ধা ছিল। তারা ১৩ আগস্ট মধুপুরগড়ের নিকটবর্তী বানারী ব্রিজ গ্রেনেট মেরে ধ্বংস করে দেয়। ওই রাতে তারা গ্রামের ভাইস চেয়ারম্যানের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। উদ্দেশ্য ছিল, ১৫ আগস্ট আরও বড় ধরনের আক্রমণের পরিকল্পনা। মধুপুরগড়ের পুলিশ তাদের অবস্থানের খোঁজ পেয়ে, ময়মনসিংহ আর্মি ক্যাম্পে খবর দেয়। রাতে ভাইস চেয়ারম্যানের বাড়ি আর্মি ঘিরে ফেলে এবং তাদের আত্মসসমর্পণের নির্দেশ দেয়। বিশ্বজিৎ নন্দী তার পাঁচ সহযোদ্ধার সাথে পরামর্শ করে, আত্মসমর্পণ না যুদ্ধ-কোনটা করবে। সবাই একই সুরে কথা বলনে, তারা আত্মসর্মপণ করবে না। মরতে হয় তো সম্মুখ যুদ্ধ করেই মরবে। আত্মসর্মপণ করলে বঙ্গবন্ধুর আত্মার সাথে বেঈমানি করা হবে। তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তারা আর্মির সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

গোলাগুলির একপর্যায়ে বিশ্বজিৎ নন্দী পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ধরা পড়েন। সামরিক আদালতে তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি ৭ বছর কনডেম সেলে থেকেছেন। যেকোনো মুহূর্তে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারত। বিশ্বজিৎ নন্দীর ফাঁসি কার্যকর না করার জন্য দেশব্যাপী আন্দোলন এবং মিছিল হয়। ছাত্রসমাজ বিশ্বজিৎ নন্দীর পক্ষে ছিল। ভারত, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংগঠন তার ফাঁসির বিরোধিতা করে।

এরশাদের সময় ১৯৮৪ সাল থেকে ১৫ দল বশ্বিজিৎ নন্দীর পক্ষে দাঁড়ায়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বজিৎ নন্দীর মুক্তির জন্য প্রতিটি সভার শুরুতেই দাবি জানাতেন। অবশেষে এরশাদ সরকার তাকে কনডেম সেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

আরেক সাহসী সৈনিক

বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করেন আরেক সাহসী সৈনিক বরগুনার মহকুমা প্রশাসক সিরাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘রেডিও খুলে যখন আমি ডালিমের কন্ঠ শুনি, সাথে সাথে মনের মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে। আমি মনে মনে বললাম, দিস ইজ ইন্ড অব মাই লাইফ। বরগুনার রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশকে বলি, প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর নামে চলবে। আমরা বঙ্গবন্ধুর কর্মচারী, র্কমর্কতা। তাঁর সাথে বেঈমানি করব না। প্রশাসন থেকে বলা হলো কেউ খুনি সরকারকে সহায়তা করবেন না। এ সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বরগুনা কলজের ছাত্র – আমজনতা সহযোগে রাস্তায় বিরাট মিছিল বের করে। বরগুনার মন্ত্রী-এমপিরা প্রশাসনকে সহায়তা করে। সংসদ সদস্য আসমত আলী শিকদার, শহাজাদা, আবদুল মালেক খান, নিজাম উদ্দিন বিদ্রোহে যোগদান করে। পটুয়াখালির রক্ষিবাহিনী এসেও বিদ্রোহে যোগ দেয়। এ সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ঢাকা থেকে শুধু পরিস্থিতি জানতে চেয়েছিল।’

সিরাজ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘মোস্তাকের আপন ভায়রা বরগুনার শাহজাদা আবদুল মালেক খান, তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী সভায়ও ছিলেন। খন্দকার মোস্তাক তাকে তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে বলেন। তিনি তা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ভাইসব বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর পা দিয়ে আমি আপনার মন্ত্রিসভায় যোগ দিব না। ২৪ আগস্ট খন্দকার মোস্তাক মেজর জিয়াউর রহমানকে আর্মি চিফ অব স্টাফ করে প্রমোশন দেয়। ক্ষমতায় বসে বরগুনার রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন তিনি। ২৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবীর, ধীরেন্দ্রনাথ সম্ভু, নিজামউদ্দিন এবং আসমত আলী শিকদারসহ ছাত্রলীগের বহু নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দিনই সিরাজউদ্দিন আহমেদকে মহকুমা প্রশাসক থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়। দুই বছর পর ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান তাঁকে বন্ড দিয়ে চাকরিতে যোগদানের নির্দেশ দেয়। কিন্তু সিরাজউদ্দিন আহমেদ কোনো প্রকার বন্ড দিয়ে চাকরিতে যোগদানে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি বন্ডদান থেকে বিরত থাকেন।’

দুঃসময়ে প্রতিবাদ

বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে ওই দুঃসময়ে যারা মাঠে নেমেছিলেনে, সত্যিই তারা প্রথমত: দেশকে এবং দ্বিতীয়ত: বঙ্গবন্ধুকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছিলেন। তাদের কোনো স্বার্থ চিন্তা ছিল না। কোনো কিছু পাওয়ার আশাও ছিল না। তাদের মাথার ওপর ঝুলত মৃত্যুর খড়্গ। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন। জাতির সেই ক্রান্তিকালে তারা কান্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন।

প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে হোঁচট খেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার প্রতিবাদ করার লোক মরে যায়নি-এ সত্য কথাটি উচ্চারিত হচ্ছিল বারবার। জাতির চেতনা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলা সহজ নয়।

রঞ্জন মল্লিক : সাংবাদিক/ আমাদের সময়