সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকান্ড পরিকল্পিত। টেকনাফ থানার প্রত্যাহারকৃত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশেই খুন হয়েছেন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। তার নির্দেশ পেয়ে শামলাপুর চেকপোস্টে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী সিনহাকে লক্ষ্য করে চারটি গুলি করেন।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের সাথে ওই দুই কর্মকর্তার ফাঁস হওয়া ফোনালাপে প্রদীপ কুমরাই যে গুলির নির্দেশদাতা তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। আর তাতে পুলিশ সুপারের সম্মতি রয়েছে বলেও অনেকে মনে করছেন। এতে পুলিশ সুপার লিয়াকতকে বলেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমারে গুলি করছে, তোমার গায়ে লাগে নাই, তুমি যেইটা করছো সেটা তার গায়ে লাগছে।’ ফোনালাপের অডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। এ নিয়ে সর্বত্রই ব্যাপক তোলপাড় চলছে।

ঘটনার পর টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়েরকৃত মামলার এজাহারেও ওসির নির্দেশে সিনহাকে গুলি করার কথা উল্লেখ করা হয়। ফৌজদারি আইন ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি পরিকল্পিত একটি হত্যাকান্ড। আর সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তাকে কেন টার্গেট করা হলো তা নিশ্চিত হওয়া না গেলে এই মামলার আসল রহস্য আড়ালেই থেকে যাবে।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, সাবেক সেনা কর্মকর্তা খুনের ঘটনাকে চেকপোস্টে তল্লাশিকালে ঘটে যাওয়া নিছক কোন দুর্ঘটনা বলা যাবে না। এখনও পর্যন্ত যেসব তথ্য বের হয়েছে তাতে স্পষ্ট এটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। বিশেষ করে তিন পুলিশ কর্মকর্তার ফোনালাপে বিষয়টি এখন একেবারেই পরিস্কার। পুলিশের বর্ণনা মতে সিনহা গুলি করতে উদ্যত হয়েছেন। কিন্তু তার আগেই পুলিশ তাকে পরপর চারটি গুলি করে। গুলিতে তিনি মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ার পরও তাকে সেখানে দীর্ঘসময়ে ফেলে রাখা হয়। তাকে বাঁচাতে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার মতো কোন মানবিক আচরণ পুলিশ দেখাতে পারেনি। এতে বুঝা যায় পুলিশের উদ্দেশ্য ভাল ছিলো না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ঘটনার পর কক্সবাজার পুলিশ যে বক্তব্য দিয়েছে তাতে অনেক ফাঁক রয়েছে। ডাকাত সন্দেহে সিনহার প্রাইভেটকারটি আটকানো হয়। অথচ তার আগে ওই প্রাইভেটকারটি বিজিবির একটি চেকপোস্ট অতিক্রম করে এসেছে। এটি ফাঁড়ির ইনচার্জসহ সবার জানা ছিলো। এরপরও গাড়িতে তল্লাশির আগেই তাকে গুলি করা হলো। আবার পুলিশ চারটি গুলির কথা স্বীকার করলেও সুরতহাল রিপোর্টে ছয়টি গুলির কথা বলা হচ্ছে। বাকি দুটি কে করল।

প্রদীপ কুমার দাশ এবং লিয়াকত আলী দুই জনই দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম নগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন। তাদের যারা কাছে থেকে দেখেছেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, প্রদীপ স্বার্থ ছাড়া কিছ্ইু করে না। এই ঘটনার পেছনেও নিশ্চয়ই তার বড় স্বার্থ ছিলো। সেটা জানা গেলে সিনহা খুনের মোটিভ উদঘাটনও সহজ হবে বলে মনে করেন তারা।

প্রদীপের কাছের লোক হিসাবে তার অনেক কুকর্মের সহযোগী ও সাক্ষী লিয়াকত। টেকনাফ যাওয়ার পর প্রদীপের নির্দেশে ক্রসফায়ারের নামে সে পাখির মতো মানুষ মেরেছে। পরিদর্শক লিয়াকত পুলিশের বিশেষ টিম সোয়াতের সদস্য। প্রশিক্ষিত সোয়াতের সদস্যরা ‘এআর-১০ স্নাইপার’ ও ‘এম-৪ কারবাইন’সহ দূরবীন লাগানো স্নাইপার রাইফেল দিয়ে এক কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে নির্ভুলভাবে আঘাত করতে পারেন। যে কারণে চোখের পলকে পরপর চারটি গুলি ছোড়েন লিয়াতক।

সব গুলিই সিনহার শরীরে বিদ্ধ হয়। ঘটনার পরদিনই লিয়াকতকে ক্লোজ করে কক্সবাজার পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ঘটনার পর সিনহার বোনের মামলার খবর পেয়ে টেকনাফ থেকে নগরীতে চলে আসেন প্রদীপ। নিজেকে অসুস্থ দাবি করে দামপাড়া পুলিশ লাইন হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে আলাদা একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। তার কাছে থাকা পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়। পরে তাকে পুলিশ পাহারায় কক্সবাজার আদালতে পাঠানো হয়।

শামলাপুর চেকপোস্টে মেজর (অব.) সিনহাকে গুলি করার ঘটনা ঘটে ৩১ জুলাই রাত ৯টা ২৫ মিনিটে। সিনহা সেখানে পৌঁছালে লিয়াকত পরিচয় জানতে চান। সিনহা গাড়ির ভেতর থেকে নিজের পরিচয় দেন। লিয়াকত তাকে হাত ওপরে তুলে বেরিয়ে আসতে বলেন। সিনহা বেরিয়ে আসার পরপরই লিয়াকত তাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সিনহাকে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওসি প্রদীপ সেখানে এসে সিনহাকে লাথি মারেন। প্রায় পৌঁনে এক ঘণ্টা পর একটি ট্রাকে তুলে সিনহাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। পথে তিনি মারা যান।

‘একজনকে ডাউন করছি স্যার’
‘একজনকে ডাউন করেছি, একজনকে ধরেছি স্যার।’ সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার পর এভাবে পুলিশ সুপারকে ঘটনা জানান পরিদর্শক লিয়াকত আলী। রাত ৯টা ২৫ থেকে ৩০ মিনিটের দিকে এসআই লিয়াকত এবং প্রদীপ দাশ পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনকে ফোন করেন।
প্রদীপ: আদাব, স্যার

মাসুদ: কী, আপনি এমন কি হইছে, বলেন
প্রদীপ: স্যার, লিয়াকতরে গুলি করছে নাকি স্যার, আমি যাচ্ছি ওখানে
মাসুদ: কে?

প্রদীপ: ঐ যে স্যার লিয়াকত স্যার ইয়াতে, চেকপোস্টে
মাসুদ: হ্যাঁ

প্রদীপ: একটা গাড়িকে সিগন্যাল দিছে, সিগন্যাল দেয়ার পরে গাড়ি থেকে তাকে পিস্তল দিয়ে গুলি করছে। ওই সময় আমি তাকে বললাম, ঠিক আছে তুমিও তাড়াতাড়ি ওকে গুলি করো। সেও নাকি তাকে গুলি করছে স্যার, আমি যাচ্ছি স্যার ওখানে স্যার
মাসুদ: যান, যান

মেজর সিনহাকে গুলি করার পর এসআই লিয়াকত ফোন করেন এসপি মাসুদকে।
লিয়াকত: আসসলামু আলাইকুম, স্যার

মাসুদ: বলো

লিয়াকত: এখানে একটা প্রাইভেট কার আছে স্যার, ঢাকা মেট্রো লেখা। আর্মির পোশাক টোশাক পরা। তাকে চার্জ করছি, সে মেজর পরিচয় দিয়ে গাড়িতে চলে যেতে চাইছিলো। পরে অস্ত্র তাক করছিলো, আমি গুলি করছি স্যার। একজন ডাউন করছি, আরেকজন ধরে ফেলছি স্যার। স্যার আমি কি করবো স্যার? আমাকে পিস্তল তাক করছে, পিস্তল পাইছি তো স্যার।

মাসুদ: আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমারে গুলি করছে, তোমার গায়ে লাগে নাই, তুমি যেইটা করছো, সেটা তার গায়ে লাগছে।