আজ ১০ ই জুলাই বাংলাদেশে তথা নোয়াখালীর ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক ও বেদনাময় দিন । একজন বীর মুক্তিযুদ্ধাকে রক্ষীবাহিনী
গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। উনি হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইন্জিনিয়ার নজির আহম্মেদ । ১৯৭৫ সালের এ দিনে এ সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে উল্লাস করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক সময়ের দালাল ওসি মোল্লা ও তার সহযোগীরা । যারা পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের খয়ের খাঁ’তে পরিণত হয়েছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার নজীর আহমেদের অপরাধ ছিল তিনি একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করতেন ।

নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার মিরওয়ারিশ পুর ইউনিয়নের মির আলীপুর গ্রামের কৃষক নওয়াব আলীর তৃতীয় সন্তান ইন্জিনিয়ার নজির আহম্মদ। গরীব পরিবারের মেধাবী সন্তান নজির আহাম্মদ নিজে লেখাপড়ার পাশাপাশি আয় করে নিজে বজরা হাই স্কুলে লেখাপড়া করতেন এবং পাশাপাশি তার দুই বৎসরের বড় ভাই জালাল আহাম্মদের ফেনী পলিটেকনিক ইন্সিটিটিউটের পড়ার খরচও কিছু জোগান দিতেন। এসএসসি পাশ করার পর মেধাবী হওয়ায় বড় ভাই জালাল আহম্মদের পরামর্শে নিজেও ফেনী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে ডিপ্লোমা সিভিল ইন্জিনিয়ারিং পাশ করেন । ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম ব্যাচে যোগদান করেন এবং ভারতে প্রশিক্ষন শেষে বাংলাদেশ প্রবেশ করেন । কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বিভিন্ন সাব সেক্টরে গ্রুপ কমান্ডার হিসাবে যুদ্ধ করেন। কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন তাহা আস্তে আস্তে ফানুস হতে লাগলো, শেখ মুজিব সরকার সেই পাকিস্তানি ভাবধারার পূঁজি বাদী সরকার, সেই পাকিস্তানি আমলা, সেই প্রশাসন, সেই ১৮৬১ সালের বৃটিশ আইন কানুন চালু করে একটি যুদ্ধ করা দেশকে পরিচালিত করতে লাগল । যার ফলশ্রুতিতে জমে উঠলো ক্ষোভ। তিনি যোগ দিলেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অংগীকার নিয়া সদ্য জন্ম নেওয়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – জাসদ এ । গনতান্ত্রিক আন্দোলন তীব্রতর করে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে রুপ দেওয়ার স্বপ্ন দেখলেন ।

ইতিমধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগে উপ সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে চাকুরির আবেদনের প্রেক্ষিতে এলো যোগদানের চিঠি। না নিজের মুক্তি আর তখন এক সন্তানের মুক্তি তথা ভবিষ্যত কে দূরে ঠেলে দিয়ে সমগ্র জাতির মুক্তির স্বপ্ন নিয়া এগিয়ে গেলেন।

১৯৭৪ এর ১৭ মার্চ জাসদের কর্মসূচির অংশ হিসাবে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাস ভবনে স্মারক লিপি দিতে গিয়ে ৫০ জনের মত জাসদ কর্মী পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর গুলিতে নিহত হোন। সারা দেশে জাসদের সাধারণ কর্মীদেরকে গ্রেপ্তার সহ নির্যাতন শুরু করে পুলিশ, রক্ষী বাহিনী ও দলীয় ক্যাডাররা । ১৯৭১ এ দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারত গিয়াছিলেন। এখন কোথায় পালাবেন !
কাপুরুষের মতো পালিয়ে না গিয়া শুরু করলেন প্রতিরোধ । গঠন করলেন বিপ্লবী গন বাহিনী । মারার জন্য যুদ্ধ নয়, বাঁচার জন্য প্রতিরোধ এ নীতিতে অবিচল থেকে নোয়াখালী র এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন , জনগনকে বিপ্লবে শরিক হওয়ার আবেদন করতেন।
এমনি করনীয় কালে ১৯৭৫ সালের ১০জুলাই নোয়াখালীর রাজগন্জ থেকে ফেরার পথে নিজ ইউনিয়নের কেন্দুরবাগ গ্রামে রক্ষীবাহিনীর গুলি ও বেয়নেট চার্জে পাকিস্তানি বাহিনীর আতঙ্ক, সারা শরীর লোমশে পরিপূর্ণ ভাল্লুকইয়া ভাই নামে খ্যাত ইন্জিনিয়ার নজির আহম্মদ বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য শহীদ হলেন।

মৃত্যু মূহুর্তে তিন বছরের পুত্র সন্তান জহিরুল ইসলাম ও স্ত্রী গর্ভে রুদ্র মাসুদকে রেখে গেলেন । বড় ছেলে জহিরুল ইসলাম এখন রাশিয়ার ও ছোট ছেলে রুদ্র মাসুদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা ।
দুই সন্তান শহীদ ইন্জিনিয়ারিং নজির আহম্মদের ডুপ্লিকেট । হঠাৎ দেখলে মনে হয় ইন্জিনিয়ার নজির আমার সামনে দাঁড়ানো।

দুঃভাগ্য যাদেরকে সামনে রেখে ইন্জিনিয়ার নজির আহাম্মদ সহ সারাদেশের বিয়াল্লিশ হাজার জাসদ কর্মী আত্মাহুতি দিলো তাদের লেজুড়বৃত্তি তে বিস্মিত হই। ইন্জিনিয়ার নজিরের সহযোদ্বা হিসাবে তাদের কাছে নিজকে অপরাধী মনে হয়।

ওপারে ভাল থাকুন। শহীদ ইন্জিনিয়ার নজির আহম্মেদ তোমায় লাল সালাম ।
লেখক-মাহবুবুর রহমান বাবুল,জাসদ নেতা ও সংগঠক।