গত ১০ বছরে ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেল অবৈধভাবে অর্জিত দুই হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন। পুলিশের অপরাধ বিভাগ (সিআইডি) তদন্তে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ ঘটনায় ঢাকার কাফরুল থানায় তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা করা হয়েছে। বহুল আলোচিত ও যুদ্ধাপরাধ মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি জাহিদ হোসেন খোকন রাজাকারের দুই ভাগ্নে বরকত ও রুবেল।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক এসএম মিরাজ আল মাহমুদ বাদী হয়ে গত শুক্রবার (২৬ জুন) ঢাকার কাফরুল থানায় মামলা করেন। মামলায় দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদ অবৈধ উপায়ে উপার্জন ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়। ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধনী ২০১৫-এর ৪(২) ধারায় এ মামলাটি করা হয়।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১০ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ফরিদপুরের এলজিইডি, বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি বিভাগের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন বরকত ও রুবেল। এছাড়া মাদক কারবার করে এবং ভূমি দখল করে অবৈধ সম্পদ করেছেন তারা। এসি ও নন-এসিসহ ২৩টি বাস, ড্রাম ট্রাক, বোল্ডার ও পাজেরো গাড়ির মালিক হয়েছেন। সেই সঙ্গে দুই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন দুই ভাই।

মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রথম জীবনে দুই ভাই রাজবাড়ীর এক বিএনপি নেতার সঙ্গী ছিলেন। তখন তাদের সম্পদ বলতে কিছুই ছিল না। ১৯৯৪ সালের ২০ নভেম্বর ওই এলাকায় এক আইনজীবী খুন হন। ওই হত্যা মামলার আসামি ছিলেন বরকত-রুবেল দুই ভাই।

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে কাফরুল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সেলিমুজ্জামান বলেন, মামলাটি দায়ের করেছে সিআইডি। মামলার তদন্তকাজ সিআইডি পরিচালনা করবে।

সিআইডির পরিদর্শক এসএম মিরাজ আল মাহমুদ বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় দুই ভাইকে গ্রেফতার দেখানো হবে। পরে আদালতে তাদের ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন জানানো হবে।

তিনি বলেন, ১৮ জুন এ ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়ে তদন্ত শুরু করি। প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারি গত ১০ বছরে অন্তত দুই হাজার কোটির অধিক টাকা অবৈধ উপায়ে উপার্জন করেছেন বরকত ও রুবেল। এরই মধ্যে দুই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন দুই ভাই।

সাজ্জাদ হোসেন বরকত ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি ছিলেন। বরকত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আর তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেল ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক ভোরের প্রত্যাশা পত্রিকার সম্পাদক এবং ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন।

এদিকে রোববার (২৮ জুন) ফরিদপুরে দুটি পৃথক মামলায় সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেল আরও দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এ নিয়ে পাঁচ দফায় এই দুই ভায়ের মোট ২২ দিন রিমান্ড হলো। ইতিমধ্যে চারটি মামলায় তারা ২০ দিন রিমান্ড খেটেছেন। এদিন বিকেলে ফরিদপুরের এক নম্বর আমলী আদালতের বিচারিক হাকিম মো.ফারুক হোসাইন রিমান্ড আবেদন শুনানী শেষে দুইভাইকে দুইদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আদালত ফরিদপুরে বিআরটিসি বাসের কাউন্টার পরিচালক দুলাল লস্করের করা চাঁদাবাজির মামলায় সাজ্জাদ হোসেন বরকতকে দুই দিন এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম চৌধুরীর দায়ের করা চাঁদাবাজির মামলায় ইমতিয়াজ হাসানকে দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামাল পাশা বলেন, রোববার দুপুরে বরকত ও রুবেলকে আদালতে হাজির করে দুটি পৃথক মামলায় ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এর আগে তিন দিনের রিমান্ড শেষ করে আদালতে সাজ্জাদ হোসেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম চৌধুরীর দায়ের করা চাঁদাবাজির মামলায় এবং ইমতিয়াজ হাসান রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে দায়ের করা অস্ত্র মামলায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

রিমান্ড শুনানির আগে রোববার দুপুরে সাজ্জাদ ও ইমতিয়াজকে কড়া পুলিশ পাহাড়ায় কোর্টে নিয়ে আসা হয়। শুনানি শেষে রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার পর বিকেলে একই নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে তাদের পুলিশ প্রহড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, গত ১৬ মে রাতে জেলা আ.লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে দুই দফা হামলার ঘটনা ঘটে। সুবল সাহার বাড়ি শহরের গোয়ালচামট মহল্লার মোল্লা বাড়ি সড়কে অবস্থিত। এ ঘটনায় গত ১৮ মে সুবল সাহা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে ফরিদপুর কোতয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। গত ৭ জুন রাতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলা মামলার আসামি হিসেবে শহরের বদরপুরসহ বিভিন্ন মহল্লায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ বরকত, রুবেল ও রেজাউল করিমসহ মোট নয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এলাকাবাসী জানান, বরকত ও রুবেলের বাবা আবদুস সালাম মন্ডল ছিলেন বিএডিসির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। অভাবের সংসারের কারণে পড়ালেখা বেশিদূর করতে পারেননি তারা। এরশাদের জমানায় ফরিদপুর শহরের রাজবাড়ী মোড়ে পরিবহনে চাঁদা উঠাতেন দুই ভাই। ’৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে পরিচয় হয় স্থানীয় বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে। এরপর থেকে ওই নেতার ঘনিষ্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। ওই সময় কোমরপুর এলাকার জাকির নামের এক যুবকের দুই হাত কেটে প্রথম আলোচনায় আসেন দুই ভাই। পরে ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এডভোকেট মহিউদ্দিন খোকনকে হত্যার অভিযোগ উঠে দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে। মামলা হয় তাদের বিরুদ্ধে। আসামি করা হয় ১ ও ৩ নম্বর। এরপর গ্রেপ্তার এড়াতে গা-ঢাকা দেন তারা। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিহত খোকনের বাড়িতে যান সমবেদনা জানাতে। অভিযোগ রয়েছে অদৃশ্য ইশারায় পার পেয়ে যান এই দুই ভাই। হত্যা মামলার রায়েও খালাস পান তারা। ফের প্রকাশ্যে এসে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।

ক্ষমতার পালা বদলে তারা ভিড়েন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। সান্নিধ্যে আসেন ফরিদপুর আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার। এরপরই ভাগ্য খুলে যায় দুই ভাইয়ের। জড়িয়ে পড়েন টেন্ডারবাজিতে। দুই ভাইয়ের টেন্ডারবাজির কারণেই এলজিইডি অফিস ঝিলটুলী থেকে তাদের নিজবাড়ি বদরপুরে স্থানান্তর করার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে।

ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী এলাকায় ১০ তলা বাড়িসহ ১০ শতাংশ জমি, ধুলদিতে পাথর ভাঙ্গা কারখানাসহ ১৫ একর জমি, চন্ডিপুরে ১০ একর জমি, সিবরামপুরে ৩ একর জমি, চন্ডিপুরে পাম্পসহ ২ একর জমি, গঙ্গাবর্দিতে ২ একর জমি, বোয়ালমারীতে ১৫ শতাশ জমি, নর্থ চ্যানেলে ৩৩ একর জমি, বদরপুরে ১ একর ৫০ শতাংশ জমি রয়েছে এই দুই ভাইয়ের। অভিযোগ রয়েছে, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ওয়ারলেছ পাড়ার মিজান চৌধুরী ও জামানের ১ একর ৪ শতাংশ জমি লিখে দিতে বাধ্য করেন বরকত। এছাড়া রুবেলের রয়েছে ঝিলটুলী টেলিগ্রাম অফিসের সামনে ৪৫ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের মোড়ে ৫.৫ শতাংশ, মুন্সীবাজারে ৩ একর, বাইপাসে ১৫ একর, ব্রাহ্মণকান্দায় ১০ একর, পাট গবেষণা কেন্দ্রের পাশে ৬ একর, চন্ডিপুরে ইট ভাটাসহ মাচ্চরে ১১ একর, মাচ্চর ইউনিয়ন পরিষদের পাশে ৬ একর, চন্ডিপুর বাবু বাড়ির পাশে ২ একর, নর্থ চ্যানেলে ১০০ একর, ধুলদিতে ১৫ একর, রাজবাড়ি রাস্তার মোড়ে ১ একর ৫০ শতাংশসহ মোট ১৮২ একর জমি।

এলাকাবাসী আরো জানান, দুই ভাইয়ের নেশা জমি করার। যেখানে যেভাবে পারেন অন্যের জমি নিজেদের কব্জায় নেন। ফরিদপুরের সবচেয়ে বিলাসবহুল গাড়ি সাউথ লাইন পরিবহনের মালিক এই বরকত ও রু‌বেল। রয়েছে অসংখ্য ট্রাক-ভেকু। ঢাকা, দিনাজপুর, গাজীপুর, সাতক্ষীরায় রয়েছে তাদের জমি, ফ্ল্যাট বাড়ি। চা বাগান, মাছের ঘের, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ও মহাখালী ডিওএইচএস, সেগুনবাগিচায় রয়েছে একাধিক অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট। বিএমডব্লিউ, হ্যারিয়ার, লেক্সাসসহ মোট ৫টি অত্যাধুনিক গাড়ি ব্যবহার করতেন তারা। এছাড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আবাসিক হোটেল, চরে রয়েছে কলা ও মাল্টার বাগান, একাধিক পেট্রোল পাম্প, ইটভাটা, রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে ব্যক্তিগত ২টি অফিস, বাইপাসে অসংখ্য দোকান। ফরিদপুর নিউ মার্কেটে রয়েছে ৪৪টি দোকান। যার সর্বনিম্ন মূল্য ১১ কোটি টাকা।উৎস-পূর্বপশ্চিমবিডি