২৫ মাসেরও বেশি সময় পর সরকারের নির্বাহী আদেশে ছয় মাসের জন্য কারামুক্ত হয়ে স্বীয় বাসভবন গুলশানের ’ফিরোজা’য় ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। গতকাল বুধবার বিকেল সোয়া ৪টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে বেরিয়ে তার গাড়িবহর বিকাল সোয়া ৫টায় গুলশানের ৭৯ নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাসভবন ‘ফিরোজা’য় পৌঁছায়। এ সময় সেখানে তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানান তার মেজো বোন বেগম সেলিমা ইসলাম, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বেগম সেলিমা রহমানসহ খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরা। হাসপাতাল থেকে বাসভবন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী। খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার গৃহকর্মী ফাতেমা বেগমও অন্য গাড়িতে এই বাসভবনে ফেরেন। দীর্ঘ সময় কারারুদ্ধ থাকায় ও অসুস্থতার কারণে ৭৫ বছর বয়সী এই নেত্রীর শরীর কিছুটা ভেঙে গেছে। তাকে হাসপাতাল থেকে হুইল চেয়ারে করে নিচে অপেক্ষমাণ গাড়িতে তোলার সময় তার চোখে সানগ্লাস আর মুখে মাস্ক পরা ছিল । ছোটো ভাই শামীম এস্কান্দার নিজে গাড়ি চালিয়ে তাকে বাড়িতে নেন। শামীমের স্ত্রী কানিজ ফাতেমাও ছিলেন ওই গাড়িতে। সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল চত্বর জুড়ে ছিল বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর ভিড়। স্লোগানে মুখর নেতা-কর্মীরা গাড়ি বহরের সঙ্গে গুলশান অবধি হেঁটে যান। ভিড় সামাল দিতে কাওরান বাজার এলাকায় পুলিশ লাঠিচার্জ করলেও নেতাকর্মীদের সরাতে পারেনি। এর আগে ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে চিকিত্সা গ্রহণ ও বিদেশে না যাওয়র শর্তে বেগম জিয়ার দণ্ডের কার্যকারিতা স্থগিত করে মুক্তির আদেশের নথি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা কর্তৃপক্ষের হাত ঘুরে গতকাল বিকালে ৩টার পর বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে পৌঁছায়। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুল হক ৩টার দিকে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দিলে হাসপাতালের ৬২১ নম্বর কেবিনে থেকে খালেদা জিয়াকে বের করে আনেন তার ছোটো ভাই।

যেভাবে মুক্তি: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে বন্দি ছিলেন খালেদা জিয়া। তার মধ্যে গত ১১ মাস ধরে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ছিলেন। বেগম জিয়ার সাজা হওয়ার পর থেকে তার মুক্তির জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে আসছিল দলটি। কিন্তু কোনোভাবেই সফল হননি তারা। তার পরিবারের পক্ষ থেকে সুচিকিত্সার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন জানানো হয়।

ইনশাআল্লাহ চিকিত্সার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা হবে: ফখরুল

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নেত্রী মুক্তি পাওয়ায় আমরা কিছুটা স্বস্তি বোধ করছি। আবার কিছুটা আতঙ্কিতবোধও করছি এই ভয়ঙ্কর সময়ে মুক্তিতে তার কোনো ক্ষতি না হয়। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া উনাকে আমরা বাসায় আনতে পেরেছি। আমরা বিশ্বাস করি—তিনি এই ঘরোয়া পরিবেশে মানসিকভাবে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠবেন। ইনশাআল্লাহ তাকে চিকিত্সার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা হবে।

ছয় সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড

মেডিক্যাল ড্যাবের মহাসচিব হারুন আল রশিদ বলেন, উনার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা বলব, উনাকে যেন বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখনো কোনো মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়নি। তবে পাঁচ থেকে ছয় সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করার সিদ্ধান্ত রয়েছে।

দুই শর্ত ভাঙলে খালেদা জিয়ার মুক্তি বাতিল

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, দুই শর্তে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হলো। শর্ত দুটি হলো—ঢাকায় তার নিজ বাসায় থাকবেন, আর এসময় তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। শর্ত ভঙ্গ করলে তার মুক্তি বাতিল হবে কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এটি বলার অপেক্ষা রাখে না।’ গতকাল বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে ব্রিফিং করে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গত দুই বছর দুই মাস ধরে খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন। দুটি মামলায় দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়ে তিনি কারাগারে আছেন। তার ছোটো ভাই শামীম ইস্কান্দাদের ব্যক্তিগত অনুরোধ ও আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মুক্তি দেওয়া যায় কি-না সেজন্য আমরা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলাম। আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং হয়ে আমাদের কাছে যখন আসে তখন আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে নির্দেশনা চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খালেদা জিয়ার ছোটো ভাই, তার বোন ও বোনের স্বামী ব্যক্তিগতভাবে মুক্তি চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী যে মানবতার নেতা, তাকে যে মাদার অব হিউম্যানিটি বলা হয় সেটা তিনি আবারও প্রমাণ করলেন।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিনি রাজনীতি করবেন কেন? তিনি এখন সাজাপ্রাপ্ত দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত। তার ছয় মাসের দণ্ড স্থগিত করা হয়েছে।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করলে সাজা স্থগিতের শর্ত ভঙ্গ হবে

অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেছেন, শর্ত সাপেক্ষে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেছে সরকার। আর সাজা স্থগিতের ক্ষেত্রে তার শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এখন উনি যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন তাহলে আমি মনে করি সাজা স্থগিতের যে শর্ত রয়েছে তা ভঙ্গ হবে। তিনি বলেন, যদি উনি শর্ত ভঙ্গ করেন তাহলে সরকার তার সিদ্ধান্ত রিকল করতে পারেন। তখন সাজা স্থগিতের বিষয়টি বাতিল হয়ে যাবে। গতকাল বুধবার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করা হয়েছে ছয় মাসের জন্য। এই সময় শেষ হলে উনি আগের অবস্থায় ফিরে যাবেন, যদি না সরকার ঐ সময় আর বর্ধিত না করে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সাজা স্থগিত মানে এই নয় যে, তিনি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। যেসব মামলায় তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত সেগুলোর বিরুদ্ধে তার আপিল বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া অন্য সব মামলার কার্যক্রমও অব্যাহত আছে। তিনি বলেন—শুধু বাংলাদেশই নয়, সাজা স্থগিতের বিধান সারাবিশ্বেই রয়েছে। আমাদের দেশে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারাটি সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই রয়েছে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।সূত্র-ইত্তেফাক