পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় গ্রামবাসীর সঙ্গে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের সংঘর্ষে বিজিবির এক সদস্যসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে উপজেলার গাজীনগর এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে আহত আরেকজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাগানের কাঠ পরিবহনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিজিবি চেকপোস্টের অদূরে গাজীনগর বাজারের কাছে এই ঘটনা ঘটেছে।

নিহতরা হলেন বিজিবির সিপাহি মো. শাওন (৩০), গ্রামবাসী দুই ভাই আহমদ আলী (২৫) ও আলী আকবর (২৭), তাঁদের বাবা সাহাব উদ্দিন মুছা মিয়া (৬০) এবং প্রতিবেশী মফিজ মিয়া (৫০)।

মাটিরাঙ্গা থানার ওসি শামছুদ্দিন ভুইয়া জানান, মাটিরাঙ্গা পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের গাজীনগর এলাকায় সংগৃহীত কাঠ একটি ট্রাক্টরে করে সমিলে নিয়ে যাওয়ার সময় টহলরত বিজিবি সদস্যরা বাধা দেন। এ সময় উভয় পক্ষে সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহগুলো উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই ব্যক্তিকে আটক করার তথ্য জানিয়েছে পুলিশ।

হাবিবুর রহমান নামের স্থানীয় একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, স্থানীয় সাহাব উদ্দিন মুছা মিয়া বাগান থেকে কাটা গাছের কিছু গুঁড়ি একটি ট্রলিতে (ট্রাক্টর) করে সমিলে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে গুমতি সড়কে টহলরত বিজিবি সদস্যরা তাতে বাধা দেন। এ সময় দুই পক্ষ বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে।

দুই পক্ষে বিতণ্ডা ও সংঘর্ষের এক পর্যায়ে বিজিবি সদস্যদের মধ্য থেকে একজন প্রথমেই আহমদ আলীর ওপর গুলি চালান। এতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে বিজিবির ওই সদস্য আহমদ আলীর বড় ভাই ট্রলিচালক আলী আকবর ও তাঁদের বাবা সাহাব উদ্দিন মুছা মিয়ার ওপর গুলি চালান। এ সময় আরো গুলিবিদ্ধ হন প্রতিবেশী মফিজ মিয়া ও হানিফ। সংঘর্ষের সময় বিজিবির সিপাহি মো. শাওনের ওপরও গুলি চালানো হয়।

এদিকে ৪০ বিজিবির অধিনায়ক সাইফুল্লাহ মো. মিরাজ বলেন, অবৈধভাবে গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বিজিবির টহলদল তাতে বাধা দিয়েছে। এ সময় কর্তন করা গাছগুলোর জব্দ তালিকা করতে চাইলে কিছু লোক বিজিবি সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। একজন বিজিবি সদস্য পড়ে গেলে তাঁর কাছে থাকা অস্ত্রটি কেড়ে নিয়ে জনৈক মফিজ মিয়া গুলি চালান। এ সময় হতাহতের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। বিজিবির পক্ষ থেকে কোনো গুলি চালানো হয়নি।

স্থানীয় দিনমজুর ফারুক জানান, সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের এই ঘটনায় গ্রামবাসী প্রতিরোধে এগিয়ে এলেও তাদের গুলি ছোড়ার হুমকি দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে গ্রামের লোকজন হতাহতদের উদ্ধার করে মাটিরাঙ্গা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় মফিজ মিয়া ও হানিফকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মফিজ প্রাণ হারান। তিনি নিহত আলী আকবরের শ্বশুর।

নিহত মুছা মিয়ার ছোট ভাই ইব্রাহিম বলেন, ‘বিজিবি সদস্যদের বাধা উপেক্ষা করে কাঠের গুঁড়িগুলো নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় বিজিবির ব্রাশফায়ারে আমার ভাই ও দুই ভাইপো নিহত হয়েছে।’ গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহিম জানান, গুলিবিদ্ধদের উদ্ধারে এগিয়ে আসায় আরো কয়েকজনের ওপর গুলি চালানো হয়েছে।

এদিকে স্বামী ও দুই সন্তান গুলিতে নিহত হওয়ার খবরে মুছা মিয়ার স্ত্রী রনছু বেগম জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাত্ক্ষণিক তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে পরে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে।

শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি, সেনাবাহিনীর গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শাহরিয়ার জামান, পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস, পুলিশ সুপার আব্দুল আজিজ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরীসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

জেলা প্রশাসক জানান, নিহতদের জন্য ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম এম সালাউদ্দিন এবং বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অথবা তাঁর প্রতিনিধি।

গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহরিয়ার জামান জানান, জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আজ (গতকাল মঙ্গলবার) দুপুর আনুমানিক পৌনে ১২টায় খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার গাজীনগর বাজার থেকে এক শ গজ দক্ষিণে বিজিবির একটি টহলদল অবৈধ কাঠ পাচার রোধে ব্যবস্থা নিলে বেসামরিক স্থানীয় লোকজন বিজিবি টহলদলকে ঘিরে ধরে। এতে বিজিবি টহলদল ও বেসামরিক জনগণের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি, বিজিবির এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও ধাক্কাধাক্কির রেশ ধরে এক পর্যায়ে বেসামরিক লোকজন বিজিবির অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় বিজিবির সিপাহি শাওন ও পাঁচজন বেসামরিক ব্যক্তির গায়ে গুলি লাগে। ফলে বিজিবি সদস্য শাওন ও বেসামরিক চার ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। বিজিবির গুইমারা সেক্টর কমান্ডার, সেনাবাহিনীর গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তাঁরা পৃথকভাবে ঘটনা তদন্তের কার্যক্রম শুরু করেছেন। সামগ্রিক ঘটনার তদন্ত শেষে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মন্তব্য