দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় গ্যাসসমৃদ্ধ এলাকা দ্বীপজেলা ভোলা। এখানকার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে বর্তমানে দৈনিক পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস তোলা হচ্ছে। ভোলা নর্থ নামে এখানে আরেকটি গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে। এই গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মালিক রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্স। দেশের স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্স সাশ্রয়ী ও সফল বলে স্বীকৃত। এর পরও বাপেক্সের ভোলার দুই গ্যাসক্ষেত্রের তিনটি কূপ খননের কাজ পাচ্ছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম।

কূপ তিনটি হচ্ছে- শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান কূপ টবগী-১ এবং ভোলা নর্থের অনুসন্ধান কূপ ইলশা-১ ও উন্নয়ন কূপ ভোলা নর্থ-২।

বিশ্বের জ্বালানি খাতে গ্যাজপ্রমের অনেক অভিজ্ঞতা থাকলেও এ কোম্পানি বাংলাদেশে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করে। এতে মানসম্মত কাজ হয় না বলে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে।

গত ১০ বছরে গ্যাজপ্রম বাংলাদেশে অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপ মিলিয়ে ১৭টি কূপ খনন করেছে। এর মধ্যে ভোলার দুটি কূপ রয়েছে। কূপপ্রতি রাশিয়ার কোম্পানিটি গড়ে ১৫২ কোটি টাকা করে নিয়েছে পেট্রোবাংলার কাছ থেকে। যেখানে বাপেক্স নিজে কূপ খননে ব্যয় করে সর্বোচ্চ ৮০ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত তিন কূপের জন্য কূপপ্রতি ২৫ মিলিয়ন ডলার দাম চেয়েছে রাশিয়ান কোম্পানিটি। এই নিয়ে দরকষাকষির জন্য আগামীকাল বুধবার জ্বালানি বিভাগে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

ভোলার গ্যাসক্ষেত্র বেঙ্গল বেসিনভুক্ত। সেখানে যে ভূকাঠামোয় গ্যাস পাওয়া গেছে, তার ভূতাত্ত্বিক নাম ‘স্টেটিগ্রাফিক স্ট্রাকচার’। দেশের অন্যসব গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে সুরমা বেসিনে। এই বেসিনের ভূতাত্ত্বিক নাম ‘অ্যান্টি ক্লেইন স্ট্রাকচার’। ভোলার দুই গ্যাসক্ষেত্রে দুই ট্রিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস রয়েছে। গ্যাসের মজুদ আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০০৯ সালের ১১ মে থেকে শাহবাজপুর ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে বাপেক্স। শাহবাজপুর ক্ষেত্র থেকে বর্তমানে ভোলায় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে (২২৫ ও ৩৫ মেগাওয়াট) গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয় শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকদেরও গ্যাস দেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, ১৯৯৫ সালে বাপেক্স ভোলার শাহবাজপুরে প্রথম গ্যাসের সন্ধান পায়। সংস্থাটি আড়াই হাজার মিটার থেকে সাড়ে তিন হাজার মিটার পাঁচটি গ্যাসস্তরের সন্ধান পায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভূগর্ভের স্তরগুলোতে খুব উচ্চ চাপ থাকায় কূপ খনন বিপজ্জনক। শাহবাজপুরের এমন ওভারপ্রেশার জোনে বাপেক্স কূপ খননে সফল হয়েছে। এই চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনোকল সিলেটের মাগুরছড়ায় এবং ২০০৫ সালে কানাডার নাইকো ছাতকের টেংরাটিলা গ্যাসকূপে দুর্ঘটনা ঘটায়। এমন সফলতার পর বর্তমানে বাপেক্সের কূপ একের পর এক বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া হচ্ছে। বাপেক্স নিজের গ্যাসক্ষেত্রে নিজেই গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান করলে তা সাশ্রয়ী হবে। এতে বাপেক্সের কর্মীদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়বে। কিন্তু বাপেক্সের কাজ কেড়ে নিয়ে বিদেশি কোম্পানিকে দিলে কর্মীরা উৎসাহ হারবেন। বাপেক্স কখনও আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে না।

এদিকে পেট্রোবাংলার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাপেক্সের সক্ষমতা কম এমন যুক্তিতে গ্যাজপ্রমকে কাজ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাপেক্স বর্তমানে শুধু শ্রিকাইলে একটি কূপ খনন করছে। সংস্থাটির বাকি জনবল ও রিগ (কূপ খননের প্রধান যন্ত্র) বসে আছে। তাই সক্ষমতার অভাব- এই যুক্তি দুর্বল।

গ্যাজপ্রম ২০১২ সালে দেশের ১০টি গ্যাসকূপ খননের ঠিকাদারি নেয়। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, প্রথম দফায় খনন করা তিতাস-২০, তিতাস-২১, সেমুতাং-৬, বেগমগঞ্জ-৩ ও শাহবাজপুর-৪- এই পাঁচ গ্যাস কূপই উত্তোলন শুরুর অল্পদিন পরই বালু ও পানি উঠে বন্ধ হয়ে যায়। পরে বাপেক্স নিজেই আবার সেগুলোর সংস্কার করে গ্যাস উত্তোলন করছে।

গ্যাজপ্রমের হয়ে কাজ করছেন এমন এক বাংলাদেশি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেশি খরচের বিষয়টি আসলে আপেক্ষিক। তারা আন্তর্জাতিক দর অনুযায়ী কাজের ধরন অনুসারে ধাপে ধাপে দাম ধরেছেন। পেট্রোবাংলা যতটুকু চাইবে সে অনুসারে মূল্য নির্ধারিত হবে। এ ছাড়া খনন কাজে কী ধরনের ম্যাটেরিয়াল ব্যবহূত হবে তার ওপরও দামের বিষয়টি নির্ভর করে। চীনের তৈরি ম্যাটেরিয়াল আর জার্মানি বা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাটেরিয়ালের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তিনি আরও বলেন, নিজ জনবলের বেতন ও রিগের খরচ ছাড়াই বাপেক্স কূপ খনন প্রকল্পের ব্যয় হিসাব করে। এ জন্য বাপেক্সের খরচ কম হচ্ছে বলে মনে হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, মাঝে কম দামে দুটি বিদেশি কোম্পানি বাপেক্সের কূপ খনন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। তাই দামের চেয়ে কাজের সফলতাই আসল।
যদিও গ্যাজপ্রমকে ২০১২ সালে দেশের ১০টি গ্যাসকূপ বিনা দরপত্রে খননের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সে অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো ছিলনা। গ্যাজপ্রমের খনন করা কূপ গুলোর মধ্যে পাঁচটিই বালি ও পানি উঠে বধ হয়ে যায় ।বন্ধ হয়ে যাওয়া কূপ গুলোকে পরে বাপেক্সকেই মেরামত করে গ্যাস উত্তোলন করার উপযোগী করার দায়িত্ব নিতে হয়।
গ্যাজপ্রেমকে প্রতিটি কূপ খননের জয় দেওয়া হয়েছিল গড়ে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা অথচ বাপেক্সের প্রতিটি কূপ খননে ব্যায় হয় ৬০ কোটি থেকে ৮০ কোটি টাকা। এছাড়াও পৃথিবীর অন্যতম সেরা দূর্নীতিগ্রস্ত কোম্পানি হলো রাশিয়ার গ্যাজপ্রম।

গ্যাস সংকটের কারণে সরকার ব্যয়বহুল তরল প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজি আমদানি করছে। এতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশের ২৬টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ২৫৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।