কালসর্প যোগ বা কালসর্প দোষ কি ?

কাল অর্থাৎ সময়, সর্প অর্থাৎ সাপ এবং যোগ অর্থাৎ অবস্থা । সময় যখন সর্পের মতো আপনাকে ছোবল মারা শুরু করে দেয় অর্থাৎ যখন আপনার কুণ্ডলীনির কিছু গ্রহের স্থান পরিবর্তনের কারণে আপনার সব কাজে বাধা আসতে থাকে বা আপনার জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ে সেই অবস্থাকে বলা হয় কালসর্প যোগ ।

কালসর্প যোগে জীবনে অনেক প্রতিকূলতা বা বাধা আসে বলে এই যোগকে অনেক কালসর্প দোষের নাম দিয়ে থাকেন । যদিও এটিকে দোষ বলা ঠিক নয় । কারণ এমন অনেক বিশিষ্ট রাজনেতা বা সেলিব্রিটিরা আছেন যাদের এই দোষটি ছিল কিন্তু আজ তাদের আমরা সকলে চিনি, আবার অনেকে তাদের জীবন পদ্ধতি এবং কর্ম পদ্ধতি অনুসরণ করার চেষ্টাও করি । তারা হলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, সচিন তেন্ডুলকার, পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং আরো অনেক খ্যাতনামা ব্যাক্তিবর্গ রয়েছেন । তাই কালসর্প যোগ যে শুধুমাত্র খারাপ বা শুধু আপনার জীবনে অসফলতা নিয়ে আসে এমনটা কিন্তু নয় । হ্যাঁ এটা অবশ্যই ঠিক যে এই যোগ জীবনে প্রতিকূলতা নিয়ে আসবে, আপনার সামনে দিন প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে কিন্তু তা সব ক্ষেত্রে আপনাকে অসফলতার দিকে নিয়ে যাবে এমনটা ঠিক নয় ।

যখন কুণ্ডলিনীর নয়টি গ্রহের মধ্যে সাতটি গ্রহ রাহু এবং কেতুর ছায়ায় চলে আসে অর্থাৎ রাহু বা কেতুর যেকোনো একদিকে বা মাঝে চলে আসে তখন কুণ্ডলিনীতে যে যোগ তৈরী হয় তাকে কালসর্প যোগ বলা হয়ে থাকে । এই সাতটি গ্রহ হলেন – সূর্য দেব, চন্দ্রমা দেব, মঙ্গল দেব, বুধ দেব, বৃহস্পতি দেব, শুক্র দেব এবং শনি দেব । যদি এই সাতটি গ্রহ রাহু-কেতুর যেকোনো একদিকে চলে আসে তাহলে সেই যোগকে কালসর্প যোগের নাম দেওয়া হয়ে থাকে । কিন্তু যদি এই সাতটি গ্রহের যেকোনো একটি গ্রহ রাহু-কেতুর ছায়ার বা ঘেরার বাইরে থেকে যায় বা কয়েক ডিগ্রির বাইরে চলে আসে তাহলে কিন্তু সেটি কালসর্প যোগ নয় । এটিকে অনেকে আংশিক কালসর্প যোগের নাম দিয়ে থাকেন কিন্তু এটি পুরোপুরি ভুল । কোনো বিদ্বান, কোনো গ্রন্থেই এই আংশিক কালসর্প যোগটিকে নাম উল্লেখ করেননি । যখন কোনো জ্যোতিষী ঠিক ভাবে বা যাকে আমরা বলি পুংখানুপুংখ ভাবে কুণ্ডলিনীর বিচার করতে পারেননা তিনি তখন সব দোষ এই কালসর্প যোগের নামে চাপিয়ে দেন বা যদি ঠিকভাবে সেই যোগ না তৈরি হয় তাহলে তার নাম দিয়ে দেন আংশিক কালসর্প যোগ ।

কিন্তু অনেক বিদ্বান এটি মনে করেন যে যদি কোনো মারক গ্রহ রাহু কেতুর ছায়ার থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে তাহলে তা দ্বিগুন ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে এবং মৃত্যু যোগ তৈরী করার ক্ষমতা পর্যন্ত রাখে । যদিও এটি অনেক কুণ্ডলিনীর ক্ষেত্রে সত্যি হতে দেখা গেছে ।

কাল সর্প যোগ সারাজীবন কাওকে অশুভ প্রভাব দিয়ে যাবে এমনটাও নয় । যখন কারো কুণ্ডলিনীতে রাহু বা কেতুর মহাদশা বা অন্তরদশা চলে তখনি এই যোগ সব থেকে বেশি প্রভাব ফেলে । বাকি সময় এই যোগের প্রভাব না এর মতোই বলা চলে ।

আবার যদি রাহু কুণ্ডলিনীতে শুন্য ডিগ্রি, আঠাশ বা উনতিরিশ ডিগ্রিতে থাকে তাহলে রাহু বলহীন হয় এবং তা সঠিক অর্থে কালসর্প যোগ নয় । এরকম অবস্থায় যদি আপনার জীবনে কোনো প্রব্লেম আসছে তাহলে তা কালসর্প যোগের কারণে কিন্তু নয়, তা আপনার কুণ্ডলিনীর গোচর গ্রহের কারণে ।

প্রকারভেদ:

মুখ্য রূপে ৭টি কালসর্প যোগের কথা জ্যোতিষ জানায়। এছাড়াও অনেক গ্রন্থে ১২ রকম কালসর্প যোগের উল্লেখ মেলে ।যেহেতু আমাদের কুণ্ডলিনীতে ১২ টি ভাব বা ঘর রয়েছে তাই ১২ রকম কালসর্প যোগের কথা এবং প্রভাব জানাচ্ছি —

১. অনন্ত কালসর্প— লগ্নে রাহু এবং কেতু সপ্তমে অবস্থান করলে এমন হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের শিকার হন, বিবাহে বিপর্যয় আসে,সাংসারিক জীবন বিঘ্নিত হয়, মামলায় বার বার হেরে যান।

২. কুলিক কালসর্প— দ্বিতীয়ে রাহু এবং অষ্টমে কেতুর অবস্থান। আক্রান্তকে তীব্র অর্থসংকটে পড়তে হয় এবং দাম্পত্য জীবনও সুখকর হয় না।

৩. বাসুকী কালসর্প— তৃতীয়ে রাহু এবং নবমে কেতুর অবস্থান। পুত্র-কন্যা নিয়ে ক্রমাগত সংকট ঘটে, জাতক/জাতিকার নিজ পায়ে দাঁড়াতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। ভ্রাতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে সংঘাত ও ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে থাকে।

৪. শঙ্খপাল কালসর্প— চতুর্থে রাহু এবং দশমে কেতু স্থিত হলে এমন হয়। হঠাৎ করে ভাগ্য বা কর্ম জীবনে অন্ধকার নেমে আসতে পারে, স্থাবর সম্পত্তি নিয়ে সংকট দেখা দেয়।

৫. পদ্ম কালসর্প— পঞ্চমে রাহু এবং একাদশে কেতু। ভাগ্য বিপর্যয়, শিক্ষা, সন্তানের সমস্যা, প্রেম-প্রীতি বিঘ্নিত এবং সর্বোপরি সাফল্য একদম আসতে চায় না, লটারি, শেয়ার বাজার, জুয়ায় বার বার বিপর্যয়।

৬. মহাপদ্ম কালসর্প— ষষ্ঠে রাহু আবং দ্বাদশে কেতু। আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনে সম্পর্কঘটিত বিপর্যয় লেগে থাকে। তাঁরা স্ত্রীর বিশ্বাস অর্জনেও ব্যর্থ হন। শত্রু বৃদ্ধি, রোগ ভোগ, অদ্ভুত চরিত্রের অধিকারী, শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং কর্মজীবনে সংঘাত লেগে থাকে। হাজতবাসও হতে পারে এই যোগে।

৭. তক্ষক কালসর্প— সপ্তমে রাহু এবং লগ্নে কেতু অবস্থান করে। আক্রান্তরা সর্বত্র ষড়যন্ত্রের শিকার হন। শারীরিক সমস্যা, দাম্পত্য কলহ, ভালবাসা বিঘ্নিত, ব্যবসায়িক সঙ্গীর সঙ্গে সংঘাত ইত্যাদি দেখা দেয় এই যোগে |

৮. কারকোটক কালসর্প যোগ— এই যোগে রাহু অষ্টমে এবং কেতু দ্বিতীয়ে অবস্থান করে। বাকি গ্রহগুলি এদের মধ্যে অবস্থান করে। অযথা নেশা করা, অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলা, সাংসারিক শান্তি বিঘ্নিত, অর্থের কষ্ট এবং দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা এই যোগে ঘটে থাকে।

৯. কলিয় বা শঙ্খচূড় কালসর্প যোগ— রাহু নবমে ও কেতুর অবস্থান তৃতীয়ে হলে জন্ম ছকে এই যোগ সৃষ্টি হয়। এই যোগে ভাগ্য বিপর্যয়, ভ্রাতৃ-ভগিনীদের সঙ্গে বিরোধ, নিজের নামে কলঙ্ক লাগা ও পিতার সঙ্গে বিরোধ ঘটে থাকে।

১০. ঘটক বা বিষধর কালসর্প যোগ— রাহু জন্মছকে দশমে ও কেতু চতুর্থে অবস্থান এবং বাকি গ্রহ সকল এদের মধ্যে অবস্থান করলে এই যোগ সৃষ্টি হয়। কর্মজীবন বিঘ্নিত, রাজনীতিতে পতন, কিছু বাজে স্বভাব, কর্মস্থলে ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে সংঘাত এই যোগে ঘটে থাকে।

১১. বৃহৎ কালসর্প যোগ— এই যোগে রাহু একাদশে এবং কেতু পঞ্চমে এবং বাকি গ্রহ এদের মধ্যে অবস্থান করলে এই যোগ সৃষ্টি হয়। এই যোগে শিক্ষায় বিঘ্ন, সঙ্গীর সঙ্গে বিরোধ, ফাটকায় ক্ষতি এবং দাম্ভিকতা প্রকাশ পায়। এই যোগে কর্মস্থানে শান্তি বিঘ্নিত ঘটতে পারে।

১২. শেষনাগ কালসর্প যোগ— রাহুর অবস্থান দ্বাদশে ও কেতু ষষ্ঠে এবং বাকি গ্রহ এদের মধ্যে অবস্থান করলে এই যোগ সৃষ্টি হয়। এই যোগে স্বার্থপরতা, চোখের সমস্যা, নিচু মানসিকতা, বিদেশ যাওয়ার যোগ, হিসাব ছাড়া খরচ হয়।

কালসর্প যোগের লক্ষণ :

যদি আপনি প্রায় সাপের স্বপ্ন দেখছেন তাহলে তা কালসর্প যোগের লক্ষণ হতে পারে । যদি আপনার প্রতিটা দিন আপনার সামনে প্রতিকূলতা নিয়ে আসছে বা যদি আপনি সফল ছিলেন হটাৎ করে অসফলতার দিকে ঢোলে পড়ছেন বা সমাজে বা বাড়িতে আপনার দিন প্রতিদিন সম্মানহানি হচ্ছে তাহলে তা কালসর্প যোগের লক্ষণ হতে পারে ।

কালসর্প যোগ থেকে মুক্তির উপায়:

কাল সর্প দোষের প্রভাব থেকে বাঁচতে বা মুক্তি পেতে অনেকে রাহুর প্রতিকারের বিধান দিয়ে থাকেন কিন্তু যদি আপনার এই যোগ চলছে তাহলে, কোনো দিন রাহুর প্রতিকার করার চেষ্টা করবেন না । কারণ এমন অনেক কুণ্ডলিনীর উদাহরণ আমার কাছে আছে যেখানে রাহুর প্রতিকার করাতে এই যোগ আরো প্রভাবশালী হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং অনেক অশুভ প্রভাব ফেলা শুরু করেছে । যদি আপনি এই কালসর্প যোগের প্রভাব কম করতে চান তাহলে প্রতিদিন ভোরবেলা “ওম নমঃ শিবায়” এই পঞ্চাক্ষরি মন্ত্রটির একটি করে মালা জপ শুরু করে দিন এবং রাতে শোবার আগে প্রতিদিন ময়ূর পালকের হাওয়া নেওয়া শুরু করে দিন এবং একটি ময়ূর পালক নিজের বেড রুমে বা শোবার ঘরে অবশ্যই রাখবেন । কিন্তু যদি এই যোগথেকে পুরোপুরি মুক্তি পেতে চান তাহলে শুনুন – কালসর্প যোগে রাহু বা কেতু দুজনেই অশুভ বা দুজনেই সমান শক্তিশালী হয় না । যদি রাহু অশুভ হয় তো কেতুর অশুভতার প্রভাব অনেক কম হয় এবং কেতু অশুভ হলে রাহুর অশুভতার প্রভাব অনেক কম হয় । আবার একটি গ্রহ খুব শক্তিশালী হলে অন্যটি অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী হয় । তাই যে গ্রহটি কম অশুভ বা যে গ্রহটি কম শক্তিশালী তার ঘরের দিক থেকে আপনি এই যোগ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন এবং এই উপায়টি একটি পার্মানেন্ট উপায় । এর জন্য পূজোর দরকার পড়ে । তাই সঠিক জ্যোতিষীর কাছ থেকে সঠিক বিধান নিয়ে যদি সঠিক উপায় করেন তাহলে জ্যোতিষ মতে একটি কথা আছে “উপায় কথা বলে” অর্থাৎ আপনি নিশ্চিত রূপে এই যোগ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন।