সরকারের তরফ থেকে ক্রমাগত উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলেও, বিশ্বখ্যাত রেটিংস এজেন্সি ফিচ বলছে, আগামী দু’বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমবে। সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি এই পূর্বাভাস দিয়েছে। প্রসঙ্গত, বিশ্বের শীর্ষ ৩ ক্রেডিট এজেন্সির মধ্যে একটি ফিচ। সংস্থাটির অর্থনৈতিক পূর্বাভাষ বিশ্বজুড়েই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কম হবে বললেও, বাংলাদেশের রেটিং আগের অবস্থানেই রেখেছে ফিচ। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দীর্ঘকালীন রেটিং আগের মতোই বিবি-।

বাংলাদেশের এই রেটিংয়ের ক্ষেত্রে শক্তিশালী জিডিপি প্রবৃদ্ধি, উচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ক্রমবর্ধমান তবে গড়পড়তা সরকারি ঋণের ভূমিকা আছে। তেমনি আছে দুর্বল অবকাঠামো নির্দেশক, খুবই স্বল্প রাজস্ব আয় ও দুর্বল ব্যাংকিং খাতের নেতিবাচক প্রভাব।

ফিচ-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গত এক দশকে বিভিন্ন নেতিবাচক পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অটুট ছিলো।
এর মধ্যে দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ঘটনাও ছিল। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার বাংলাদেশের। ‘বিবি’ ক্যাটাগরিতে থাকা দেশগুলোর মিডিয়ান প্রবৃদ্ধি হার ৪.২% হলেও, গত ৫ দশকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হার ছিল গড়ে ৭.৪ শতাংশ। সরকারের অনুমান বলছে, ২০১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮.১ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ ঘরোয়া চাহিদা বৃদ্ধি। উচ্চ রেমিট্যান্স ও রপ্তানি। তবে ২০২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে ৭.৫ শতাংশ ও ২০২১ অর্থবছরে ৭.২ শতাংশ হবে বলে ফিচ পূর্বাভাষ দিয়েছে। যদিও আগামী বছর ৮.২ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের।

নিজেদের পূর্বাভাষের পেছনে কারণ হিসেবে ফিচ বলছে, বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের বৈদেশিক চাহিদা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কমছে। বিশেষ করে বৈশ্বিক বাণিজ্য ধীর হয়ে যাওয়ার পর এই প্রবণতা দেখা গেছে। এছাড়া বিবি বিভাগের দেশগুলোর মিডিয়ান মুদ্রাস্ফীতি ৩.৪ শতাংশ হলেও বাংলাদেশের ৫.৫ শতাংশ।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক। ২০১৯ সালের অক্টোবর নাগাদ এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩২.৪ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া কয়েকটি বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পে বিপুল যন্ত্রপাতি ও পণ্য আমদানির প্রভাবও পড়ছে অর্থনীতিতে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাবিনিময় হারকে শক্তভাবে সমর্থন দিতে গেলে আন্তর্জাতিক রিজার্ভে চাপ পড়তে পারে। তবে বিদেশে থাকা কর্মীদের রেমিট্যান্স বাড়ছেই। ১২ মাসে ১৭.১ বিলিয়ন ডলার দেশে ঢুকেছে রেমিট্যান্স হিসেবে। যা একবছর আগের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। যদিও এই সময়টায় গড় অভিবাসন কমেছে ২২ শতাংশ।

দেশের মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশ হলো তৈরিপোশাক। ২০১৯ অর্থবছরে ৩৪.১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে এই খাত থেকে, যা ১৮ অর্থবছরের তুলনায় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার বেশি। তবে বর্তমান অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি সম্ভবত কমবে।

২০১৭ সালে বৈশ্বিক পোশাক বাজারে বাংলাদেশের শেয়ার ছিল ৬.৫ শতাংশ। তবে বৈশ্বিক বাণিজ্যের দুর্বল অবস্থার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ থেকেও খুব বেশি লাভবান হচ্ছে না বাংলাদেশ।
ফিচ পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, সরকারের ঘাটতি ২০১৯ অর্থবছরে বেড়েছে। গতবার ৪.৬ শতাংশ হলেও এবার তা হয়েছে ৪.৮ শতাংশ। এর কারণ দুর্বল রাজস্ব আদায়। রাজস্ব এখন জিডিপি’র মাত্র ৯.৬ শতাংশ, যা নাইজেরিয়া ব্যতীত ফিচের হিসাবে বিশ্বের সর্বনিম্ন। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে নতুন ট্যাক্স আইন বাস্তবায়ন হলেও জিডিপি অনুপাতে রাজস্ব আদায় সহসাই বাড়ার সম্ভাবনা কম।

ফিচ আরও বলেছে, সরকার ২০১৯ অর্থবছরে রাজস্বের ৩.৫ গুণেরও বেশি ঋণ নিয়েছে। যা ফিচ র‌্যাংকিং-এর বিবি বিভাগের দেশগুলোর মিডিয়ান মাত্রার (১.৬ গুণ) দ্বিগুণেরও বেশি। এই ঋণ ক্রমেই বাড়ছে। সরকার ইঙ্গিত দিয়েছে যে, সরকারি ব্যাংকগুলোর পুনঃঅর্থায়ন বন্ধ করা হবে, যেন ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা চর্চা উন্নততর হয়। তবে ফিচ মনে করে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে আরো অর্থ জোগান দেয়া হলে সরকারের ঋণ ট্রাজেক্টরিতে ইতিবাচকও হতে পারে।

ফিচ-এর বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার উচ্চমাত্রায় রয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়, চাপে থাকা ঋণের পরিমাণ হয়তো যতটা বলা হয় তার চেয়েও বেশি। এছাড়া সরকারি ব্যাংকের অবস্থা গুরুতর। তবে পরিস্থিতি কম ক্ষতিকর হয়েছে এই কারণে যে, দেশের বেসরকারি খাতের ঋণের সামগ্রিক হার অনেক কম, জিডিপি’র ৩৭ শতাংশ।

দুর্বল পরিচালন মান, সহজে ব্যবসা করার সূচকে খারাপ অবস্থাও নেতিবাচক হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। তবে ফিচ-এর বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বেশ ভালো হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। যা বিদেশি ভ্রমণকারীদের জন্য আর বিপত্তি তৈরি করছে না। যদিও নিরাপত্তা সংক্রান্ত দুর্ঘটনা বা রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করে দেয়া যায় না। অবকাঠামো দুর্বলতার কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যদিও সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেশ বাড়িয়েছে ও বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে মনোযোগী হয়েছে।