অপরাধ সংবাদ | তারিখঃ অক্টোবর ১৩, ২০১৯ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 642 বার
ধানমণ্ডি এলাকা ছেড়ে রাজধানীর অজ্ঞাত স্থানে আশ্রয় নিয়েছে ফয়সাল খান মুন্নার পরিবার। গতকাল শুক্রবার বহিষ্কার হওয়া যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান ও তাঁর বাহিনীর ভয়ে আতঙ্কিত পরিবারটি। শুক্রাবাদের ৮/২/এ বাড়িটি বিক্রির পাওনা টাকা আদায়ে কাজী আনিসুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ফয়সাল গত ৩১ ডিসেম্বর ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর সড়কে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ফয়সাল পাঁচ কোটি টাকায় বাড়িটি বিক্রি করেছিলেন আনিসের কাছে। ২০ লাখ টাকা দিয়ে আনিস বাড়িটি লিখে নেন। বাকি টাকা না দিয়ে বাড়িটি দখল করেন আনিস। বর্তমানে সাততলা ওই বাড়িতে বসবাস করছেন আনিসুর রহমানের শ্বশুর বাচ্চু মুন্সী।
শুক্রাবাদের ৮/২/এ নম্বর বাড়ি বিক্রির পাওনা টাকা সম্পর্কে জানতে চাইলে ফয়সালের স্ত্রী প্রেমা বলেন, ‘আমার জানা মতে আনিসুর রহমান কোনো টাকা দেয়নি। তিন বছর ধরে আমার স্বামীকে টাকা দেব-দিচ্ছি বলে সময় পার করেছে। আমিও দু-একবার টাকা চাইতে গেছি। টাকাও দেয়নি, আমার সঙ্গে দেখাও করেনি।’
আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করবেন কি না—জানতে চাইলে প্রেমা বলেন, ‘আমার স্বামী নেই, সন্তান নিয়ে কিভাবে জীবন বাঁচাব সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। ঢাকা শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই বাড়িটা আনিস দখল করেছে। ওর বিরুদ্ধে মামলা করলে আমাদের নিরাপত্তা কে দেবে? তবে সুযোগ পেলে সন্তানদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে দাঁড়াব। তাঁর কাছে বিচার চাইব।’
জানা গেছে, বহিষ্কৃত যুবলীগ দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসের সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকত ১২ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী। ওই সন্ত্রাসীদের বেশির ভাগই ছাত্রদলের। রাজধানীতে রয়েছে তাঁর সাতটি ব্যাবসায়িক অফিসসহ ২৫টি ফ্ল্যাট। ভালুকায় রয়েছে ১৭৫ বিঘা জমি। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন ১৫০ কোটি টাকা। আর পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়ে এক হাজার ২০০ জনকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে ভিজিটিং কার্ড ছাপানোর অনুমতি দিয়েছেন। এসবি করেছেন যুবলীগের ক্ষমতার অপব্যবহার করে।
দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আনিসের সন্ত্রাসী বাহিনী
আনিস অজ্ঞাত স্থানে চলে গেলেও তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী ঠিকই মাঠে সক্রিয় রয়েছে। গত শনি ও রবিবারও এ সন্ত্রাসীদের আনিসের ৭১, মতিঝিল কার্যালয়ের সমানে মহড়া দিতে দেখা গেছে। যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সরদার মোহাম্মাদ আলী মিন্টু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি কাজী আনিসের সম্পদ ও দুর্নীতি নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করি বলে তাঁর সন্ত্রাসীরা কয়েক দিন আগে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে আমাকে ঘিরে ধরে এবং শাসিয়ে বলে, আনিস ভাইয়ের বিরুদ্ধে লেখালেখি করলে জীবনে বাঁচতে দেব না।’
এই সন্ত্রাসীদের মধ্যে রয়েছেন খান নিয়ন, বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলায়। একসময় ছিলেন ছাত্রদলের নেতা। নাজমুল হোসেন, তাঁর বাড়ি ভোলায়। নিজ এলাকায় জড়িত ছিলেন ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে। মোক্তাদির শিমুল, তাঁর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। নিজ জেলায় জড়িত ছিলেন ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে। নড়াইলের সাবেক ছাত্রদলকর্মী সুন্দর রানা, চুয়াডাঙ্গার একসময়কার ছাত্রদল ক্যাডার ফিরোজ, হাজারীবাগের পেশাদার সন্ত্রাসী আরিফ, জয়, মুকসুদপুরের সাজ্জাদ, শরীয়তপুরের ইউসুফ হোসেন সুজন, ব্রাহ্মবাড়িয়ার যুবলীগ নেতা শ্যামল রায়, লক্ষ্মীপুরের নোমান ও সাতক্ষীরার বাবুল।
রাজধানীতে আনিসের সাতটি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান
বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা পরিচালনার জন্য রাজধানীতে আনিসের সাতটি অফিস রয়েছে। আনিসের অনুগতরাই এসব অফিস দেখভাল করেন। এর মধ্যে ধানমণ্ডি ৪ নম্বর সড়কের ১৫ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় আনিসের কেনা ফ্ল্যাটে একটি ব্যাবসায়িক অফিস রয়েছে। ওই অফিসে তাঁর টেন্ডার বাণিজ্যের একটি অংশ দেখভাল করেন ছাত্রদলের সাবেক ক্যাডার চয়ন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের পঞ্চম তলায় রয়েছে আরেকটি অফিস। এ অফিস থেকে বিদ্যুৎ ভবনের টেন্ডার বাণিজ্য দেখভাল করেন আনিসের শ্বশুর বাচ্চু মুন্সী ও মুকসুদপুরের সাজ্জাদ। রমনা ভবনের ওই অফিসের পাশেই রয়েছে আরেকটি অফিস। এ অফিসে বসেন সাবেক ছাত্রদল নেতা খান নিয়ন ও ভোলার জুয়েল। এঁরা দেখাশোনা করেন শিক্ষা ভবন ও সিটি করপোরেশনের টেন্ডার। ৭১, মতিঝিলের চারতলা অফিসে বসেন মুকসুদপুরের সাবেক ছাত্রদল নেতা মিলন। আনিসের পক্ষে তিনি ক্রীড়া ভবনসহ অন্যান্য ভবনের টেন্ডার দেখাশোনা করেন। লালমাটিয়ার সি-ব্লকে রয়েছে নাটক ও বিজ্ঞাপন নির্মাণের একটি অফিস। এ অফিসের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মুরাদ নামের এক যুবলীগ নেতার ওপর। ৭১, মতিঝিলে আরেকটি অফিস রয়েছে আনিসের। ওই অফিসে একটি অনলাইন টিভি চালুর প্রক্রিয়া চলছিল। সেটার দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মনির নামের একজনের ওপর। আনিসের সব ব্যবসার হিসাব রাখার জন্য একজন প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা রয়েছেন। বাবুল নামের ওই প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার বাড়ি মুকসুদপুর উপজেলার রাজপাট গ্রামে। ৭১, মতিঝিল অফিসে বসে বাবলু দেখাশোনা করেন আনিসের শেয়ার ব্যবসা।
আনিসের যত সম্পদ
গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার ভাবড়াসুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান। ঢাকায় এসে পোশাক কারখানা ও বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে একটি বেসরকারি অফিসে কাজ করার পর তিন হাজার টাকা বেতনে পিয়ন হিসেবে চাকরি নেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। পরে পিয়ন থেকে কম্পিউটার ম্যান। এরপর উপদপ্তর সম্পাদক। ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার পর আনিসকে মৌখিকভাবে দপ্তর সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়। দরিদ্র পরিবারের সন্তান আনিস যুবলীগের ওমর ফারুক যুগে শুধু দলের পদ ও কমিটি বিক্রি করে কামিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। হয়ে উঠেছেন অগাধ বিত্তের মালিক।
যুবলীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওমর ফারুক চৌধুরীর খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ায় আনিস যুবলীগকে নিজের মতো ব্যবহার করেছে। প্রায় এক হাজার ২০০ জনকে কেন্দ্রীয় নেতার পরিচয়ে কার্ড ছাপার অনুমতি দিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে গড়ে পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়েছে আনিস।’
আনিসের একসময়কার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহযোগী, একাধিক যুবলীগ নেতা এবং আনিসের গ্রামের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তাঁর বিপুল সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে ধানমণ্ডির ৯/এ সড়কে ৫০ নম্বর বাড়িতে তিন হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। ধানমণ্ডির ১০ নম্বর সড়কে ২২ নম্বর বাড়িতে বি/১৩ নম্বর ফ্ল্যাট। এ ফ্ল্যাটটি ছয় কোটি টাকায় কেনা হয়েছে সাবেক একজন ধনাঢ্য মন্ত্রীর কাছ থেকে। এ বাড়িতে আনিস বসবাস করেন। স্বামীবাগে মিতালী স্কুলের গলিতে ৫৪ নম্বর বাড়িতে রয়েছে আরেকটি ফ্ল্যাট। রামকৃষ্ণ মিশন রোড়ে ৭/২ হোল্ডিয়ে রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। একই সড়কে ৭/১/সি হোল্ডিংয়ে রয়েছে তিনটি ফ্ল্যাট। ধানমণ্ডির ল্যাবএইডের বিপরীতে ৪ নম্বর সড়কে ১৫ নম্বর ভবনে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট। শান্তিনগর এলাকায় রয়েছে পাঁচটি ফ্ল্যাট। ধানমণ্ডির রায়ের বাজারের কেয়ারী সড়কে রয়েছে একটি বাড়ি।
গুলশান-২-এ নাভানা টাওয়ারে রয়েছে তিনটি দোকান। এ দোকানগুলোতে চলে আনিসের মোবাইল ফোনসেটের ব্যবসা। এ ব্যবসা দেখাশোনা করেন লক্ষ্মীপুরের যুবলীগ নেতা শুভ। উত্তরার রাজলক্ষ্মী ও রাজউক মার্কেটে রয়েছে আনিসের ২০টি দোকান।
ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় রয়েছে অনিসের ১৭৫ বিঘা জমি। ওই জমি দেখাশোনা করেন ভালুকা উপজেলার যুবলীগের সভাপতি রিপন ও সাধারণ সম্পাদক পিরুল।
আনিসুর রহমানের মা নেভিগেশন নামের দুটি কার্গো জাহাজ সমুদ্রপথে চলাচল করছে। নিজ গ্রাম মুকসুদপুরের বোয়ালিয়ায় তিন বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করেছেন আলিশান প্রাসাদ। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে ইউএনও অফিসের পাশে ও কলেজ মোড়ে কিনেছেন দুটি বাড়ি। মুকসুদপুরে মা ফিলিং স্টেশন নামে রয়েছে একটি ফিলিং স্টেশন। আরেকটি নির্মাণাধীন। নিজ গ্রাম বোয়ালিয়ায় কিনেছেন ১৫০ একর জায়গা। ওই জায়গায় করেছেন মাছ ও হাঁসের খামার। নারায়ণগঞ্জে আছে একটি চটকল।উৎস -কালের কন্ঠ
Leave a Reply