ফেনীর বহুল আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন হাজারীকে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভূক্তি নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। গত বুধবার রাতে গণভবন থেকে এমন একটি সংবাদ মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। রাতেই কয়েকটি টেলিভিশন, অনলাইন এবং পরদিন পত্রিকায়ও সংবাদটি ফলাও করে প্রকাশিত হয়। পরের দিন দুপুরে সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।

বুধবার রাতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের উদ্বৃতি দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে সামনে রেখে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, য্গ্মু-সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা গণভবনে গিয়ে প্রধামন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এসময় জয়নাল হাজারীকে উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ফেনীর এই সাবেক সংসদ সদস্য। গত সেপ্টেম্বরে জয়নাল হাজারীর চিকিৎসার জন্য ৪০ লাখ টাকা অনুদানও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় তাকে ভালোভাবে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।

খবরটি জানাজানি হলে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমসহ অনেকেরাতেই জয়নাল হাজারীকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিনন্দন জানান। আলাউদ্দিন নাসিম ফেনীর রাজনীতিতে জয়নাল হাজারী বিরোধী হিসেবে পরিচিত।

অবশ্য পরদিন দুপুরে সচিবালয়ে জয়নাল হাজারী প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার এ ধরনের খবর জানা নেই। খবরটি কোথা থেকে এলো তাও জানি না। কে দিলো এই খবর, তাও জানি না। শুধু এটুকু জানি, ফেনী জেলা সম্মেলন হবে। একটা তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে কথা প্রসঙ্গে জয়নাল হাজারী অসুস্থ, তার চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী কিছু সহযোগিতা করেছেন।তিনি সিঙ্গাপুর গেছেন কি না নেত্রী সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, আমার কাছে এসেছিলেন, বলেছিলেন তিনি অপারেশনের জন্য সিঙ্গাপুর যাবেন। এখানে উপদেষ্টা করার কোনো নির্দেশনা নেই।’

দুপুরের দিকে আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমও তার ফেসবুকে পুনরায় স্ট্যাটাস দিয়ে বলেন, ‘খবরটা মনে হয় সত্য নয়। যাই হোক নেত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’ এতে সন্দেহ আরো ঘনিভূত হয়।

বিকালে সিঙ্গাপুরের হাসপাতাল থেকে ফেসবুক লাইভে আসেন ফেনী আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন হাজারী। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়নি- এমন প্রচারকে বিভ্রান্তিমূলক বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাকে উপদেষ্টা কমিটির সদস্য করা হয়নি, এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারে কেউ কান দেবেন না। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করতে চাই, আমাকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বুধবার রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে তাতে সই করে আওয়ামী লীগ অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এ সময় বাহাউদ্দিন নাছিমসহ তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং অবশ্যই আমি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। এ ব্যাপারে কোনো বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা নেত্রীর এখতিয়ার। এটা তো অন্য কারও জানার কথা নয়। তাই আমি পরিষ্কার করে বলছি, আমাকে অবশ্যই আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়েছে। যে ফোরামে আমির হোসেন আমু ভাই, তোফায়েল ভাই সদস্য, সেই জায়গায় স্থান দিয়ে শেখ হাসিনা আমার প্রতি আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। এত বিরোধিতা, এত চক্রান্ত, মিডিয়ার এত আক্রমণের পরও তিনি আমার প্রতি যে আন্তরিকতা দেখালেন, তা নজিরবিহীন। পৃথিবীর কোনো নেতা-নেত্রী তাদের কোনো কর্মীর প্রতি এতটা দরদ দেখিয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না।’

সবাইকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মিথ্যায় বিভ্রান্ত হবেন না। ওরা কেন বিভ্রান্ত করতে চাইছে জানেন, ওরা মনে করছে, এরপরই আমি ফেনীতে যাব। আমি ফেনীতে গেলেই তাদের অস্তিত্ব বিলীন হবে। কিন্তু এই ধারণা তাদের কতটা সত্য আমি জানি না। আমি উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হলেও নেত্রী বলা ছাড়া ফেনীতে যাব না। যদি নেত্রী বলেন যেতে, তার কোনো প্রয়োজন যদি থাকে, তাহলে তো যাবই। সেটা আমি মরে গেলেও কোনো অবস্থাতে কেউ রুখতে পারবে না।’

জয়নাল হাজারী আরো বলেন, আমি ওবায়দুল কাদের সাহেবকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ধন্যবাদ জানাচ্ছি এ কারণে যে, রাজনীতি করতে গেলে কিছু মিথ্যা কথা বলতে হয়। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনো মিথ্যা কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, আমি কিছু জানি না। এ নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা হয়নি। তার এই বক্তব্য একশ পার্সেন্ট সত্য। কারণ, এটা নিয়ে নেত্রী কারও সঙ্গে আলোচনা করেননি। কারণ কাউকে উপদেষ্টা কমিটিতে রাখা অথবা উপদেষ্টা করা, এটা নেত্রীর একান্তভাবে নিজস্ব এখতিয়ার। দলের বিগত জাতীয় সম্মেলনে তাকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘এটা অনেকটা নিয়োগ।এটা কাউন্সিলের মাধ্যমে হওয়ার বিষয় নয়। আমার আগেও যাদের উপদেষ্টা করা হয়েছে, তখনও কারও সঙ্গে আলোচনা করে আনেননি। শুধু একটা চিঠি আওয়ামী লীগ অফিসে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকেই এটা চলে যায় মিডিয়ায়। এটা ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আলাপ করে করার কোনো দরকার নেই। ওনার জানারও কোনো দরকার নেই। আমাকে যে নেত্রী ৪০ লাখ টাকা দিয়েছেন, সেটাও তো তিনি জানতেন না। আমি নিজে ওনার বাসায় গিয়ে জানিয়ে এসেছি।

জয়নাল হাজারী ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রায় বিশ বছরের বেশি সময় ধরে ফেনী জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-২ আসন থেকে ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে তিনবার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। ২০০১ সালের ১৭ আগস্ট যৌথবাহিনীর অভিযানের মুখে ফেনী থেকে দেশান্তরী হন একসময়ের দাপুটে আওয়ামীলীগ নেতা জয়নাল হাজারী। ২০০৯ সালে মামলার স্তুপ নিয়ে দেশে ফিরেন। একেএকে সব মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেও হারানো প্রভাব ফিরে পাননি। একপর্যায়ে ফেনী ছেড়ে ২০১০ সাল থেকেই রাজধানীতে বসবাস করছেন। জয়নাল হাজারী ‘হাজারিকা প্রতিদিন’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন।