বেশ কিছুদিন ধরেই রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, এলিফ্যান্ট রোড ও বনানীতে ক্যাসিনোর রমরমা ব্যবসা চলে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার র‌্যাবের অভিযানে এগুলোর আসল চিত্র জনসমক্ষে আসে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ক্যাসিনো ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও সাংগাঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার হাতে। তবে এখানকার টাকার ভাগ পেত পুলিশের সংশ্লিষ্ট থানার ওসি, ডিসি, রাজনৈতিক নেতা, ওয়ার্ড কমিশনার, সাংবাদিক ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীরা। র‌্যাবের হাতে খালেদ মাহমুদ আটক হওয়ার পর তিনি এ তথ্য জানিয়েছের। ১৯ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার র‌্যাবের এক কর্মকর্তরা জানান, প্রতিটি ক্যাসিনো থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লেনদেন হতো। লাভের অংশের ভাগ সবার কাছে পৌঁছায় দিতে হতো। থানার ওসির কাছে মাসিক হারে কয়েক লাখ টাকা দিতে হতো। সংশ্লিষ্ট জোনের পুলিশের সহকারী কমিশনার ও উপ-কমিশনারের কাছেও মাসিক হারে টাকা পৌঁছে যেত, এমনকি যারা উপ-পরিদর্শক বা পরিদর্শক লেভেলের, তাদেরও টাকা দিতে হতো। তবে তাদের পরিমাণটা ছিল কম। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ক্যাসিনো এলাকার পুলিশের বিট অফিসারও পেত টাকার ভাগ। তিনি জানান, টাকার ভাগ রাজনৈতিক নেতার পকেটেও যেত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হতো। কাউকে কাউকে গাড়ি উপহার দিতে হয়েছে। অনেককে দিতে হয়েছে দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকা দামের মোবাইল ফোন। এমন নেতাদের তালিকাও করা হচ্ছে। টাকার ভাগ যেত অনেক সাংবাদিকের পকেটেও। এরই মধ্যে খালেদ সবার তালিকা র‌্যাবের কাছে দিয়েছেন।

র‌্যাবের সূত্রটি জানায়, ক্যাসিনোর টাকার ভাগ দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও চলে যেত। যেসব সন্ত্রাসী দেশের বাইরে থাকে, তারাই মূলত এই ভাগ পেত। র‌্যাবের কাছে খালেদ জানিয়েছে, মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনির সন্ত্রাসী নাজির আরমান নাদিম ও শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের হয়ে ঢাকায় কাজ করেন খালেদ। চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনোর টাকা ওমানের মাসকটে থাকা সন্ত্রাসী নাদিমের কাছে পাঠান খালেদ। সেখান থেকে জিসানও ভাগ পায় টাকার। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান বর্তমানে ভারতের পাসপোর্ট দিয়ে জার্মানিতে স্থায়ী হয়েছে। জিসানের দুবাইয়ে চারটি গোল্ডের দোকান আর আল ফজিরা সিটি জায়েদ শেখ মার্কেটে রয়েছে নাইট ক্লাব। এসব ব্যবসায় চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ীর শেয়ার রয়েছে। ওই সুবাদে জিসান জার্মানি থেকে দুবাইয়ে আসা-যাওয়া করে। ঢাকায় তার যেখানে যেখানে আধিপত্য ছিল, এর সবই নিয়ন্ত্রণ করতেন খালেদ।

বুধবার রাত ৮টা ২৫ মিনিটে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গুলশানের বাসা থেকে আটক করে র‌্যাব-১। এরপর তাকে র‌্যাব-৩ কার্যালয়ে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার দেওয়া তথ্য মতে, কমলাপুরের ইস্টার্ন টাওয়ারের টর্চার সেলে অভিযান চালায় র‌্যাব। কেউ চাঁদা দিতে না চাইলে অথবা তার কথামতো না চললে তাকে ডেকে এনে টর্চার সেলে নির্যাতন করা হতো বলে জানান র‌্যাবের কর্মকর্তারা। পরে সেখান থেকে একটি প্লাস, কয়েকটি হকিস্টিক ও লাঠি উদ্ধার করা হয়। ক্যাসিনোগুলো থেকে পুলিশের সংশ্লিষ্ট জোনের কর্মকর্তারা টাকার ভাগ নিতেনÑ এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে আমার তেমন কিছু জানা নেই। তবে কেউ টাকা নিয়ে থাকলে সেটিও তদন্ত হবে এবং প্রমাণ হলে আইন অনুযায়ী শাস্তি হবে।

জানা গেছে, এ ব্যবসায় জড়িত রয়েছে কেন্দ্রীয় ও মহানগর উত্তর-দক্ষিণ যুবলীগের একশ্রেণীর নেতা। অবৈধভাবে চালানো এসব জুয়ার আসরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কমপক্ষে ছয় নেতা মাঝে মধ্যে অংশগ্রহণ করেন। ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য নেপাল, থাইল্যান্ডসহ চারটি দেশ থেকে প্রশিক্ষিত নারীদের আনা হচ্ছে। প্রশিক্ষিত জুয়াড়ির পাশাপাশি নিরাপত্তা প্রহরীও আনা হচ্ছে বিদেশ থেকে। ক্যাসিনোগুলোয় প্রতি রাতেই কোটি কোটি টাকা উড়ছে। এর পরিমাণ কমবেশি ১২০ কোটি টাকা হতে পারে। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ৮টি স্থানে যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের এক শীর্ষ নেতার তত্ত্বাবধানে ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বহুতল ভবনের ছাদ দখলে নিয়ে ক্যাসিনো চালানো হচ্ছে। এখানেই মূলত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ছয় নেতাসহ অনেকের আনাগোনা রয়েছে। রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকায় তিনটি ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এক সাংগঠনিক সম্পাদক। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্পোর্টিং ক্লাব, অভিজাত এলাকার ক্লাব ও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে রাত গভীর হলেই বসছে কোটি কোটি টাকার জুয়ার আসর। মতিঝিলের ক্লাবপাড়া ছাড়াও দিলকুশা, ব্যাংক কলোনি, আরামবাগ, ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, কাকরাইল, গুলিস্তান, ওসমানী উদ্যান, বঙ্গবাজার এলাকায় নিয়মিত জুয়ার আসর বসে। মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় অবস্থিত ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে অনানুষ্ঠানিক ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই অভিযোগ রয়েছে গুলশান লিংক রোডের ফু-ওয়াং ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, নিউমার্কেট এলাকার এজাজ ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, পল্টনের জামাল টাওয়ারের ১৪ তলাসহ বেশ কয়েকটি নামিদামি রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে।

রাজধানীর ক্যাসিনোগুলোয় ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, কাটাকাটি, নিপুণ, চড়াচড়ি, ডায়েস, চরকি রামিসহ নানা নামের জুয়ার লোভ সামলাতে না পেরে অনেকেই পথে বসছেন। এতে পারিবারিক অশান্তিসহ সামাজিক নানা অসঙ্গতি বাড়ছে। ভুক্তভোগীরা সর্বস্বান্ত হলেও জুয়ার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আয়োজক চক্র। আর এ কাজে সহায়তা দিচ্ছে একশ্রেণীর প্রভাবশালী। অথচ আইন অনুযায়ী দ-নীয় অপরাধ হলেও অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু লোককে ম্যানেজ করেই দিনের পর দিন চলছে এসব কর্মকা-। তবে সরেজমিন দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারির পর সেগুনবাগিচায় কয়েকটি ক্যাসিনো দুই দিন ধরে বন্ধ রয়েছে।

যুবলীগের তত্ত্বাবধানে ৬০টি বড় ক্যাসিনো চললেও সংগঠনটির থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লাতেও বসছে জুয়ার আসর। পাড়া-মহল্লার জুয়ার আসরগুলোতেও লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা হচ্ছে। আর যুবলীগের কেন্দ্রীয় ও মহানগর উত্তর-দক্ষিণের একশ্রেণীর নেতাদের শেল্টারে ৬০ স্পটে চলছে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা জুয়ার খেলা। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার খেলা হচ্ছে। পাহারায় নিয়োজিত থাকে বিদেশ থেকে আনা নিজস্ব অস্ত্রধারী টিম। তাদের আইনি ঝামেলা থেকে সুরক্ষা দেয় খোদ পুলিশ প্রশাসনেরই কিছু অসাধু কর্মকর্তা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বড়ো ৬০টি ক্যাসিনোয় একেকটি স্পটে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি টাকার জুয়া খেলা হয়। ওই হিসাবে রাজধানীর জুয়ার স্পটগুলোয় দৈনিক ১২০ কোটি টাকা উড়ছে। এ টাকার একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে চলে যায় বিদেশে। বহুতল ভবনের ছাদ ও অভিজাত ক্লাবগুলোয় রাতভর জুয়ার আড্ডা চলে। অনেক ক্ষেত্রে পেশাদার জুয়াড়িরা ক্লাব-গেস্ট হাউজের জুয়া পরিচালনা করলেও নেপথ্যের শেল্টারদাতা হিসেবে থাকেন যুবলীগের নেতা।

রাজধানীর সেগুনবাগিচা-মতিঝিল-আরামবাগে খেলাধুলা চর্চার জন্য গড়ে ওঠা নামিদামি ক্লাবগুলো বাস্তবে পরিণত হয়েছে ক্যাসিনোয়। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলোও জুয়ার বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। গভীর রাতে ক্লাবগুলোয় আসতে শুরু করে বিত্তবানদের গাড়ি। তাদের সঙ্গে থাকে ঢাকাই সিনেমার উঠতি নায়িকা থেকে শুরু করে নামিদামি মডেল। এসব মডেল-অভিনেত্রী জুয়ার আস্তানায় ‘এস্কর্ট গার্ল’ হিসেবে পরিচিত।

সূত্র জানায়, যুবলীগের একশ্রেণীর নেতার ছত্রচ্ছায়ায় এ সর্বগ্রাসী জুয়ার আস্তানা এখন ছড়িয়ে পড়ছে আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানীর অলিগলিতেও। ক্লাবের বাইরে বিভিন্ন এলাকার গেস্ট হাউস ও ফ্ল্যাট বাসাতেও এ ধরনের আয়োজন করা হচ্ছে। বাদ পড়ছে না বস্তি এলাকাও। নিকেতন, নিকুঞ্জ, উত্তরা, রূপনগর, খিলগাঁও, লালবাগ, হাজারীবাগ, বাড্ডার অসংখ্য বাসায় নিয়মিত জুয়ার আসর বসানো হয়। এসব আসরে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ছিনতাইকারী, ছিঁচকে চোর, পকেটমার, মলম পার্টির সদস্যরাও অংশ নেয়। উত্তরার একটি অভিজাত ক্লাবে নেপালিসহ কয়েক বিদেশি নারী-পুরুষের সহযোগিতায় চালানো হচ্ছে অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য।

উত্তরার পাশাপাশি দক্ষিণখান, আশকোনাতেও রয়েছে ক্যাসিনো। জুয়ার আসরগুলো থেকে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, মাস্তান, কমিউনিটি পুলিশের ইউনিট, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পিএস-এপিএসদের নাম লিখে দৈনিক বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দেয়া হচ্ছে। জুয়াড়িরা খেলতে আসা লোকদের কাছ থেকে কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। জুয়া খেলতে গিয়ে অনেক পরিবারের সন্তানরাও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছে ভুক্তভোগী পরিবারসহ এলাকার মানুষজন। যুবলীগের নেতারা জড়িত থাকায় পুলিশ জুয়া খেলায় সরাসরি মদদ দিতে বাধ্য হচ্ছে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ একটি প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছে, রাজধানীতে যুবলীগের বিভিন্ন অপতৎপরতা চলছে। তাকে অবহিত করা হয়েছে ঢাকায় অন্তত ১০০টি ক্যাসিনো চলছে যুবলীগের তত্ত্বাবধানে। পুলিশের এই প্রতিবেদন পেয়ে যুবলীগের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কয়েক নেতাকে যুবলীগের ওপর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ঢাকায় যুবলীগের নেতারা অবৈধভাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বহুতল ভবনের ছাদ দখলে নেয়া হয়েছে। যুবলীগের সবার আমলনামা আমার কাছে রয়েছে। এসব বন্ধ করতে হবে। আমি জড়িত সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি।

উল্লেখ্য, বুধবার বিকেল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত পল্টন ও মতিঝিল এলাকার কয়েকটি ক্যাসিনোয় অভিযান চালায় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে ক্যাসিনোগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ও মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। এর পাশাপাশি আটক করা হয় দুই শতাধিক ব্যক্তিকে।
উৎস -সংবাদ অনলাইন