অপরাধ সংবাদ | তারিখঃ সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৯ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 687 বার
উত্তরা বিআরটিএর দালালচক্র নিয়ন্ত্রণ, প্রভাব খাটিয়ে প্রশিক্ষণ গাড়ি ভাড়া দেওয়া, পরিবহনে চাঁদাবাজি, গার্মেন্ট ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ নানা বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠেছেন নিত্য চন্দ্র ঘোষ। তিনি তুরাগ থানা যুবলীগের আহ্বায়ক। রাজনৈতিক ক্ষমতা তাঁর বাণিজ্য-বেসাতির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। উত্তরা-গাজীপুরে ১৭টি মিষ্টির দোকানের মালিক তিনি। যদিও তাঁর দাবি, ১৭টি নয়, সাতটি মিষ্টির দোকান রয়েছে তাঁর।
রাজনীতিকে ব্যবহার করে বাণিজ্য করা নেতারা কিভাবে যুবলীগের পদ-পদবি পান জানতে চাইলে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব। যুবলীগের কেউ অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে তার জন্য যুবলীগের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
যুবলীগ নেতা নিত্য চন্দ্র ঘোষের আয়ের বড় একটি উত্স উত্তরার বিআরটিএ কার্যালয়ে দালালচক্র নিয়ন্ত্রণ। তুরাগ থানা যুবলীগের আহ্বায়ক নিত্য ঘোষ, যুগ্ম আহ্বায়ক নাসিরউদ্দিন নাসিম, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সাদেকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক শাহীন মিলিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন এই
দালালচক্র। এই দালালচক্র থেকে আসা অর্থের বড় একটি ভাগ পান নিত্য ঘোষ। এ ছাড়া সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে বহু খাত থেকে অর্থ আয় করেন তিনি। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, উত্তরা বিআরটিএ কার্যালয়ের দালালচক্র নিয়ন্ত্রণ থেকে প্রতি মাসে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা আয় হয়। ওই টাকার চার ভাগের এক ভাগ পান নিত্য ঘোষ।
তুরাগ থানার ধউর এলাকায় নিত্য ঘোষের বাড়িসংলগ্ন ধউর সরকারবাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে স্লুইস গেট-আব্দুল্লাহপুর-উত্তরা বিমানবন্দর সড়ক হয়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ বাস মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল করে। এসব বাসের একাধিক মালিক ও পরিবহন শ্রমিকরা জানান, প্রতি মাসে বাসপ্রতি ৮০০ টাকা দিতে হয় নিত্য ঘোষকে। ওই এলাকার যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় নিত্য ঘোষকে টাকা না দিয়ে ওখান থেকে বাস চালানো সম্ভব নয়। এ খাত থেকে নিত্য ঘোষের প্রতি মাসে আয় তিন লাখ ২০ হাজার টাকা।
তুরাগের ধউর এলাকার সরকারবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলাচলকারী একটি পরিবহনের এমডি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নেতাদের চাঁদা না দিয়ে বাস চালানো যায় না। আমরা দিই। দিতে হয়। নিত্যবাবু সরকারি দলের নেতা, টাকা না দিয়ে কোনো উপায় নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার পরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে আপনি চালু করে দিতে পারবেন? যদি পারেন তাহলে আমার নাম প্রকাশ করুন, না পারলে থাক।’
তুরাগ থানার ধউর, কামারপাড়া, গুলগুল্লা, পুরান কাইলা, সুনামের ট্যাক এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪৫টি গার্মেন্ট কারখানা রয়েছে। ওই গার্মেন্ট মালিকরা তাঁদের কারখানার জুট দিতে বাধ্য নিত্য ঘোষকে। অসহায় একাধিক গার্মেন্ট মালিক কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের কারখানার জুট খোলা বাজারে যে দামে বিক্রি করতে পারতেন, তার তিন ভাগের এক ভাগ দামে নিত্য ঘোষকে দিতে বাধ্য হন। নিত্য ঘোষের পক্ষে জুট ব্যবসা দেখেন তাঁর ভাইপো শয়ন চন্দ্র ঘোষ। যদিও শয়ন চন্দ্র ঘোষ কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি কোনো প্রকার জুট ব্যবসার সঙ্গে জড়িন নন। তবে স্থানীয়রা জানান, নিত্য ঘোষের রাজনৈতিক প্রভাবে শয়ন ঘোষই জুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ধউর এলাকার একজন আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তুরাগের ধউর এলাকায় জুট বাণিজ্যের সঙ্গে নিত্য ঘোষ জড়িত। শিল্প মালিকরা রাজনীতির সন্ত্রাসের কাছে অসহায়। তাঁদের কিছু করার নেই।’
সরেজমিন দেখা গেছে, তুরাগ থানার ধউর সরকারবাড়ি সড়কে প্রায় আড়াই একর জায়গার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে নিত্য ঘোষের মিষ্টির কারখানা এবং বসবাসের বাড়ি।
রাজধানীর উত্তরা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ১৭টি মিষ্টির দোকানের মালিক নিত্য ঘোষ। তুরাগ থানার ধউর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রভাবে নিত্য ঘোষ আঙুল ফুলে কলাগাছ নয়, বটগাছে পরিণত হয়েছেন। একই এলাকায় বসবাসকারী নিত্য ঘোষের পরিবারের অন্য সদস্যরা, এমনকি তাঁর আপন চাচা-চাচি ছোট্ট একটি মুদি দোকানের ব্যবসা করে কোনো রকমে সংসার চালান। মাত্র কয়েক বছর আগেও নিত্য ঘোষেরও একই অবস্থা থাকলেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতা তাঁর ভাগ্য পাল্টে দেয়। কয়েক মাস আগে নিত্য ঘোষ তাঁর মেয়ের বিয়ের বিশাল আয়োজন করে তাক লাগিয়ে দেন এলাকাবাসীকে। জামাতাকে উপহার দেন প্রিমিও গাড়িসহ সংসারের যাবতীয় দামি আসবাব।
তুরাগ থানার একজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০০৮ সালের আগেও নিত্য ঘোষকে দেখা গেছে বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে দুধ সরবরাহ করতে। যুবলীগ নেতা হওয়ার পর দ্রুত তাঁর আর্থিক উন্নতি হতে থাকে। এখন তিনি অনেকগুলো মিষ্টি দোকানের মালিক। তাঁর জীবনযাত্রা আমূল বদলে গেছে। একসময় রিকশায় চড়া মানুষ এখন গাড়ি হাঁকিয়ে চলেন।’
তাঁর এই অর্থনৈতিক উত্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে নিত্য চন্দ্র ঘোষ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী পরিবার। ব্যবসা করেই অনেকগুলো মিষ্টির দোকানের মালিক হয়েছি। কারখানা করেছি, বাড়ি করেছি। তবে ১৭টি নয়, আমার মিষ্টির দোকান সাতটি।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাজনীতি করি আদর্শের কারণে, বাণিজ্যের জন্য নয়। পরিবারের লোকেরা আমাকে বারবারই বলছে রাজনীতি ছেড়ে দিতে। রাজনীতিতে এসে আমার বরং অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।’
বিআরটিএর দালালচক্র নিয়ন্ত্রণ করে মাসে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয়, প্রশিক্ষণ-পরীক্ষায় গাড়ি ভাড়া নিতে বাধ্য করা, জোর করে জুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন চাঁদাবাজির বিষয়গুলো বেমালুম অস্বীকার করে নিত্য ঘোষ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এগুলো অপপ্রচার। আমি রাজনীতি করি। রাজনীতির প্রতিপক্ষরা এগুলো রটায়।’
কিন্তু দলের একাধিক নেতা ও বিআরটিএর কর্মকর্তারা তাঁর কথা বলেছেন, এমনটি উল্লেখ করলে নিত্য ঘোষ বলেন, ‘এগুলো একেবারে বাজে কথা।’ সূত্র-কালেরকন্ঠ
Leave a Reply