রীতিমতো নদী দখল করে বহুতল মার্কেট গড়ে উঠেছে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায়। জেলার খরস্রোতা সোনাই নদীর বুক চিরে ১০ তলা ভবনের নির্মাণযজ্ঞ এখন শেষ পর্যায়ে।

জমি নদীর হলেও মালিক বনে গেছেন স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান এসএফএএম শাহজাহান। যিনি সায়হাম গ্রুপের চেয়ারম্যানও বটে। যার আপন ভাই যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসির আসামি হয়ে এখন কারাগারে। প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তিনি সরকারবিরোধী একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির অর্থদাতা।

মাধবপুর ব্রিজের পাশে সোনাই নদীর জমি দখল করে তিনি তা মোটা অঙ্কে বিক্রি করে দিয়েছেন বিশ্বাস বিল্ডার্সের কাছে। প্রতিষ্ঠানটি উপজেলা চেয়ারম্যানের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নির্বিঘ্নে মার্কেট নির্মাণ করে যাচ্ছে। এভাবে নদী দখলের বিরুদ্ধে স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ও বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী একাধিকবার বিক্ষোভ মিছিলসহ প্রতিবাদ সমাবেশ করে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ইতিমধ্যে ভবনটির ৭০ শতাংশ কাজ শেষ। ১০ তলা ভবনের ৭ম তলার ছাদ দেয়া হয়ে গেছে।

প্রসঙ্গত, সায়হাম গ্রুপের চেয়ারম্যান এসএফএএম শাহজাহানের বড় ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার যুদ্ধাপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধের দায়ে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। স্বাধীনতার পর মোহাম্মদ কায়সার কৌশলে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিমন্ত্রীও বনে গিয়েছিলেন।
সেই কায়সারের আপন ছোট ভাই এসএফএএম শাহজাহান এখন মাধবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান। নদীর জায়গা দখল করে যেখানে সায়হাম ফিউচার কমপ্লেক্স নির্মিত হচ্ছে তার পাশেই মাধবপুর উপজেলা কমপ্লেক্স। সরকারি এই জমি বিশ্বাস বিল্ডার্সের কাছে বিক্রি করে দিলেও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভবনটির জন্মের সঙ্গে তিনি তার গ্রুপের নাম রাখতে চান।

প্রধান সড়ক থেকে দেখলে ভবনটির অবস্থান ঠিকমতো বোঝা যায় না। অপর পাড়ে লোকালয়ে ঢুকে নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়ালে বোঝা যায় কত বড় সর্বনাশ করা হয়েছে সোনাই নদীর। ২৩ আগস্ট নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে এ প্রতিবেদকের কথা হয় পার্শ্ববর্তী আদাইর গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ মিশির মিয়ার সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আগে এই নদী এ রকম মৃতপ্রায় ছিল না।

বরং এতটাই খরস্রোতা ছিল যে, সাঁতার দিয়ে অন্যপাড়ে যাওয়াও কঠিন ছিল। কিন্তু এখন দুই পাড় দখল হয়ে যাওয়ায় নদী মরে যাচ্ছে। নদীর সেই উত্তাল ঢেউ এখন আর চোখে পড়ে না। সোনাই নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজের অবস্থান দেখলেও নদী দখলের বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়।
স্থানীয়রা বলছেন, নদীর জায়গা দখল করে বিশাল এই ভবন একদিনে গড়ে ওঠেনি। প্রকাশ্যে দিনের পর দিন অনিয়মের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই ভবন ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। অথচ রহস্যজনক কারণে স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা কোনো ব্যবস্থা নেয়ার বদলে চুপচাপ থাকার পথ বেছে নেয়। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ এই ভবন নির্মাণে সহায়তা করেন বর্তমান সরকারের সাবেক একজন মন্ত্রী।

মাধবপুর বাজারের বাসিন্দা শংকর পাল বলেন, নদীর জায়গা একদিনে দখল হয়নি। দিনে দিনে প্রভাবশালীরা এটা দখল করেছে। দখল প্রতিরোধে স্থানীয়রা মিছিল-মিটিংসহ নানা ধরনের কর্মসূচিও পালন করে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত প্রতিবাদপত্র দেয়া হয়। কিন্তু এসব প্রতিবাদ বেশিদূর এগোয়নি। বন্ধ হয়নি নদী পারে অবৈধ নির্মাণকাজও।

সূত্র জানায়, সোনাই নদীর পাড় দখল করে সায়হাম ফিউচার কমপ্লেক্স নির্মাণকে কেন্দ্র করে একাধিক মামলা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডও মামলা করে। পরিবেশবাদীরাও ছিলেন সোচ্চার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই কাজে আসেনি। প্রথমে স্বল্প পরিমাণ জায়গায় ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হলেও এখন তা বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তার লাভ করেছে। ভবনের নির্মাণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা বলছেন, নদীর পাড়ের একটি বিশাল অংশের শেষ সীমানা পর্যন্ত নির্মাণকাজ চলবে।

স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, সরকারের চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ হতে পারে না। হাতিরঝিল দখল করে অবৈধভাবে নির্মিত বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত বর্তমান সরকারই নিয়েছে।

তাই সোনাই নদী দখল করে গড়ে ওঠা এই বিশাল স্থাপনাও অবিলম্বে ভেঙে ফেলতে হবে। কারণ ক্ষমতা অপব্যবহারের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে এই ভবনটি নদীর পাড়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে।

সায়হাম ফিউচার কমপ্লেক্স যেখানে নির্মিত হচ্ছে সেখানে মোট জমির পরিমাণ ২৪৪ শতাংশ। হঠাৎ করেই জায়গাটি টিন দিয়ে ঘিরে নির্মাণ কাজ শুরু করে সায়হাম। তবে ইতিমধ্যে শত কোটি টাকায় জমিসহ ভবন অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে সায়হাম গ্রুপ। বর্তমানে ভবনটির মালিক ঢাকার বিশ্বাস বিল্ডার্স লিমিটেড।
নদীর জায়গা দখলের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাধবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও সায়হাম গ্রুপের মালিক এসএফএএম শাহজাহান ২৩ আগস্ট তার গ্রামের বাড়িতে যুগান্তরকে বলেন, ‘সায়হাম ফিউচার কমপ্লেক্স নদীর জায়গায় নির্মিত হয়নি। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এ নিয়ে তদন্ত করে কোনো অনিয়ম পায়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র নিয়েই ভবনটি নির্মিত হচ্ছে।’

নদী দখলের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বাস বিল্ডার্সের প্রজেক্ট ম্যানেজার প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, ‘২০১২ সালে আমরা এই সম্পত্তি কিনে নিয়েছি। আমরা কেনার পরও নদী কমিশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা একাধিকবার পরিদর্শন করে। একাধিক তদন্ত কমিটিও সরেজমিন তদন্ত করেছে। কিন্তু কোনো সংস্থা নদীর জায়গা দখলের সত্যতা পায়নি।

আইন অনুযায়ী নদীর পাড়ে দেড়শ’ ফিটের ভেতরে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বা জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না এমন কথা বলা হলে ভবনের নির্মাণ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলেন, এসব আইনগত বিষয় তারা বোঝেন না। নকশা অনুমোদন করেছে স্থানীয় পৌরসভা। নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে বিশ্বাস বিল্ডার্সের পরিচালক আবুল ফয়েজ বলেন, এই ভবনের আইনগত সকল বৈধ কাগজপত্র তাদের হাতে রয়েছে।সূত্র -যুগান্তর