জাতীয় স্বদেশ, সম্পাদকীয় | তারিখঃ মে ২৬, ২০১৯ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 843 বার
মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খান বীরবিক্রম। ডাক নাম আবু। দাদা ডাকতেন ‘শামসুল ইসলাম’ বলে। কিন্তু দাদি বলতেন ‘নূরুন্নবী খান’। বাবা দুজনের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেন। আকিকা দিয়ে ছেলের নাম রাখেন ‘শামসুল ইসলাম মোহাম্মদ নূরুন্নবী খান’। সংক্ষেপে ‘এস আই এম নূরুন্নবী খান।’ কিন্তু আমাদের কাছে তিনি নবী ভাই। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় বঙ্গবন্ধু সরকার তাকে বীরবিক্রম খেতাব দেয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান তার বিরুদ্ধে ক্যু’র মিথ্যা অভিযোগ এনে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করাসহ তাকে এক বছরের জেল দিয়েছিল। তাই আমৃত্যুই তিনি নামের শেষে গর্বের সঙ্গে লিখতেন ‘বরখাস্ত’ শব্দটি।
নবী ভাই এখন প্রয়াত। ২২ মে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকার সিএমএইচে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বেশ কিছুদিন আগে তার মুখোমুখি হয়েছিলাম যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। তার বলা সেই কথাগুলোই আজ ইতিহাস হয়ে রইল।
হাজি হাবিবুল্লাহ খান ও শামসুন্নাহার বেগমের প্রথম সন্তান নূরুন্নবী খান। বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীধরপাড়া গ্রামে। আইএসসি পাস করেই তিনি ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়, বুয়েটের তড়িৎকৌশল বিভাগে। সময়টা ১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি। বুয়েটে তখনো প্রকাশ্য রাজনীতি করা যেত না। ড. রশিদ ছিলেন ভাইস চ্যান্সেলর। আটজন মিলে গোপনে বুয়েটে প্রথম ছাত্রলীগের কার্যক্রম শুরু করেন নূরুন্নবীরা। হারুন চৌধুরী, তোবারক, শফিউদ্দিন, মোহাম্মদ আলী প্রমুখ ছিলেন তার সঙ্গে। এতে ছাত্রত্ব চলে যাওয়ারও ভয় ছিল তখন। কিন্তু তবু তারা পরোয়া করেননি। ডালুকে আহ্বায়ক করেই বুয়েটে ছাত্রলীগের প্রথম কমিটি গঠন করে তারা। অতঃপর ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে পরপর দুবার নূরুন্নবী বুয়েট ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি হন। পরে ১৯৬৯ সালে তিনি ইউকসুর (প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় ছাত্র সংসদ) ভিপি হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। তার মুক্তির দাবিতে দুর্বার ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন নূরুন্নবীরা। বুয়েটে বসেই ছাত্রনেতারা চূড়ান্ত করেন এগারো দফা। সেই ইতিহাসের সাক্ষী ছিলেন নূরুন্নবী খান। তার ভাষায়Ñ “ডাকসুর ভিপি তখন তোফায়েল আহমেদ। চারটি দল ছিলÑ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ও এনএসএফ (দোলন গ্রুপ)। সম্মিলিতভাবে এর নাম দিলাম ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। এর মুখপাত্র করা হয় ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদকে। তার অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব ছিল ইউকসুর ভিপির অর্থাৎ আমার ওপর।”
ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে নূরুন্নবী যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে তিনি চলে যান পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে, কোয়েটা স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড টেকটিকসে। ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলে ওই ট্রেনিং। ওখানে পাকিস্তানি সেনাদের সামরিক প্রস্তুতিটা দেখে তিনি পালিয়ে আসার চেষ্টা করেন। তার ভাষায়Ñ ‘কোয়েটায় ছিল সিক্সটিন রিজার্ভ ডিভিশন। একটা আর্মির লাস্ট রিসোর্স হলো রিজার্ভ ডিভিশন। কিন্তু দেখলাম কয়েক দিন পরপরই রিজার্ভ থেকে কয়েক ইউনিট ইস্ট পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে। এমন কী ঘটছে সেখানে যে রিজার্ভ থেকে সেনা পাঠাতে হবে! আমরা গোপনে এসব নিয়ে আলোচনায় বসতাম। একসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পাকিস্তান থেকে কৌশলে পালিয়ে চলে আসি ঢাকায়।’ ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রুপস নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন নূরুন্নবী খান। কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ২৯ মার্চ ১৯৭১। সিভিল ড্রেসে বেরিয়ে বিভিন্ন জায়গা হয়ে চলে যান নড়াইলে। সেখান থেকে ঝিকরগাছা বর্ডার দিয়ে পৌঁছান ইন্ডিয়ায়।
এপ্রিলের দিকে মেজর শাফায়াত জামিলের সঙ্গেই নূরুন্নবী চলে যান রণাঙ্গনে। যুদ্ধ করেন থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে। শাফায়াত জামিল ছিলেন থার্ড বেঙ্গলের সিইও। রেজিমেন্ট রেইজ করার দায়িত্ব তিনি দেন নূরুন্নবীকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পতœীতলা থেকে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম পর্যন্ত ক্যাম্পগুলো ঘুরে ঘুরে নূরুন্নবী ১১০০ ট্রুপসের বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে তুলেছিলেন। কয়েকটি কোম্পানি নিয়ে ওই সময় অপারেশন পরিচালনাও করেন দিনাজপুরের বিভিন্ন জায়গায়। থার্ড বেঙ্গল এরপর বাহাদুরাবাদ অপারেশনের দায়িত্ব পায় এবং সফল হয়। পরে সিলেটকে মুক্ত করার নির্দেশ এলে তারা শিলং হয়ে চেলা সাব-সেক্টরের বাঁশতলায় অবস্থান নেন। স্বাধীনতা লাভের আগ পর্যন্ত নূরুন্নবী থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে সরাসরি অংশ নিয়ে নেতৃত্ব দেন ছাতক, গোয়াইনঘাট, ছোটখেল, রাধানগর, সালুটিকর, লামাকাজিঘাটসহ গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে।
অসীম সাহসী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা বীরবিক্রম নূরুন্নবী খান। একটি দুর্ধর্ষ অপারেশনের কথা বলেন তিনি। তার ভাষায়Ñ ‘ভারতের সঙ্গে যৌথবাহিনী গঠিত হয়েছে তখন। ওরা সাপোর্টিং ফোর্স। কর্নেল রাজ সিং এলেন। ২৬ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে আসে ফাইভ ফাইভ গুরখা রেজিমেন্টও। ওরা অ্যাটাক করবে রাধানগরের ওপর। আমাদের দিতে হবে গ্রাউন্ড সাপোর্ট। রাধানগর-গোয়াইনঘাট রাস্তায় পাকিস্তানিদের এলএমজি আর মেশিনগানের কারণে চারজন অফিসারসহ প্রায় ৭৫ জন গুরখার সেনা মারা যায়। রাজ সিং ২৮ নভেম্বর তারিখ ভোররাতে আবার অ্যাটাকে যেতে বললেন। সিদ্ধান্ত নিই সারপ্রাইজ অ্যাটাক করব। আমার দুটি কোম্পানিতে ১৬০ জন। চারটা প্লাটুন নিয়ে যাব ফ্রন্টাল অ্যাটাকে। ছোটখেল গ্রামের এক সাইড দিয়ে এগোব। প্রত্যেককে দিলাম থার্টি সিক্স হ্যান্ড গ্রেনেড। অ্যাটাকটা হবে সুইসাইডাল। শহীদ হওয়ার জন্য সবাইকে শপথও করালাম। কোন প্লাটুন কোথায়, কীভাবে, অ্যাটাক করবে সব বুঝিয়ে দিই। দৌড়ে ওদের বাংকারগুলোতে উঠে যাব। ওদের পজিশনের সামান্য আগেই গ্রেনেড থ্রো করব। একসঙ্গে বিস্ফোরিত হবে ১৪০টি গ্রেনেড। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা।
শাফায়াত জামিল স্যার এসে প্রথম রাজি হলেন না। বললেন ‘এক দিন আগেই গুরখারা মরেছে, তোমরা কেউ জীবিত ফিরবে না।’ তখন হাত তুলে সবাই বলল ‘স্যার, দেশের জন্য শহীদ হতেও রাজি আছি।’ দেখেন, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো খবর রাখে নাই কেউ। শাফায়াত স্যারকে দিলাম সবচেয়ে বাঁ দিকের প্লাটুনে। আমি মাঝখানে। এভাবে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানিদের ২০০ গজের ভেতর চলে যাই। খুব ভোর তখন। কুয়াশাও পড়েছে খুব। কাছেও কিছু দেখা যায় না। সবাই ওদের সীমানায় ঢুকে পড়ে নিঃশব্দে। গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটালাম। ট্রুপস খেড়ের আগুন বাংকারে দিতেই জীবিত পাকিস্তানি সেনারা দৌড়ে পাশের কাশবনে আশ্রয় নেয়। ওই অপারেশনে আমাদের আটজন শহীদ হয়েছিলেন। শাফায়াত জামিল স্যারও গুলিবিদ্ধ হন। কাশবনে থাকা পাকিস্তানি আর্মিরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এভাবে মৃত্যুকে বাজি ধরেই ছোটখেল আর আলমনগর দখল করি আমরা। যুদ্ধ করা জাতি, যুদ্ধ করেই দেশ পাইছি আমরা। রক্ত দিয়া এই ম্যাপ তৈরি করছি। আমাদের ম্যাপ রক্তের ম্যাপ, ত্রিশ লক্ষ শহীদের ম্যাপ। দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ের ম্যাপ।’
স্বপ্নের দেশ পেয়েছেন কি? এমন প্রশ্নে খানিক নীরবতা। অতঃপর তিনি বলেন ‘কোনো ক্রমেই সে দেশ পাই নাই। আমরা তো নিজের জন্য যুদ্ধ করি নাই। দেশের সব মানুষকে বাঁচাতে যুদ্ধ করেছি। আমরা জেনেশুনেই জীবন দিতে গিয়েছিলাম। বাঁইচা আছি, এটাই এখন বোনাস। স্বপ্ন ছিল একটা বৈষম্যহীন সোনার দেশ পাব। কোনো অন্যায় আর জুলুম-নির্যাতন সেখানে থাকবে না। সর্বক্ষেত্রে ন্যায়ের শাসন থাকবে। কিন্তু আজ কেউ হাজার কোটি টাকার মালিক। আবার কারও হাতে ৫০০ টাকাও নাই। দেশের সম্পদের আশি পারসেন্ট আছে দুই পারসেন্ট লোকের কাছে। এই বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা তো দেখি নাই।’ কী করা উচিত? তার উত্তরÑ ‘১৯৭৫ সালে বিএমএর এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ভাষণে ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। আমরা চাই বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণটাই আজ বাস্তবে কার্যকর করা হোক।’
রক্তের বিনিময়ে মানচিত্র আনা এই যোদ্ধার কণ্ঠ আমৃত্যু সরব ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। সুবিধা লাভের আসায় তিনি যেমন আপস করেননি, তেমনি সত্য বলতেও কখনো কুণ্ঠাবোধ করেননি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সংগঠিত ‘সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের’ ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। একাত্তরের প্রায় প্রতিটি অপারেশন নিয়ে লিখেছেন একটি করে বই। সংগ্রহ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ সব ভিডিও চিত্র, যা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রজন্মের মধ্যে। তার রচিত সেই বইগুলো আর সংগৃহীত ভিডিওই মুক্তিযুদ্ধের অকাট্য দলিল হিসেবে রয়ে গেল।
তার মৃত্যুতে সরকার কিংবা তিনি যে দলের অনুসারী ছিলেন সেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বা তার স্মৃতিবিজড়িত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কোনো শোকবার্তা দেয়নি। গণমাধ্যমগুলো নীরব। কিন্তু ইতিহাসে বীরদের মৃত্যু নেই। প্রজন্মই বাঁচিয়ে রাখবে মুক্তিযোদ্ধা নূরুন্নবী খানের বীরত্বের ইতিহাসকে। তাই পাহাড়সম আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশেই বলেছিলেন শেষ কথাটিÑ ‘তোমরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটি জেনে নিও। ওই বীরত্বের ইতিহাসই তোমাদের পথ দেখাবে। নিজের কথা ও কাজে সৎ থেকো। মনে রেখো, রক্তে পাওয়া দেশের ম্যাপটিকে তোমাদেরই তুলে ধরতে হবে।’
সালেক খোকন
লেখক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও লেখক
সূত্রঃ দেশ রূপান্তর
Leave a Reply