জাতীয় স্বদেশ | তারিখঃ ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 337 বার
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতালের ভবনের তৃতীয় তলার স্টোর রুমে এই আগুন লাগে। তবে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, হাসপাতালের নিচতলার স্টোর রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়।
আগুন লাগার খবরে রোগী, স্বজন, চিকিৎসক ও হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আগুন ও ধোঁয়ার কুণ্ডলি থেকে রক্ষা পেতে রোগী ও স্বজনরা ভয়ে ও আতংকে আর্তচিৎকার শুরু করে দেন। যে যেভাবে পারে নেমে আসেন হাসপাতাল থেকে। ঘটনার পরপরই বিভিন্ন স্থান থেকে সরকারি-বেসরকারি শতাধিক অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে পৌঁছে রোগীদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট তিন ঘণ্টা চেষ্টার পর রাত ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। রাত ১১ টার দিকে আগুন সম্পূর্ণরুপে নিভিয়ে ফেলে। অগ্নিকান্ডে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও ভর্তি হওয়া প্রায় ১২শ’ রোগীকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার সময় এক শিশুর মৃত্যু ঘটেছে।
এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তায় কলেজ গেটে অবস্থিত বেসরকারি কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। গতকাল রাত ১০ টার দিকে কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তব্যরত দুই চিকিৎসক ডা. দীনাউর রহমান ও ডা. ফেরদৌসি এ পূর্ণা জানান, সন্ধ্যা ৬টার পর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে এক বছর বয়সের এক শিশু রোগীকে স্বজনরা কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আমরা পরীক্ষা করে দেখি যে রোগী আগেই মারা গেছে। এ কারণে শিশুর নাম ও ঠিকানা হাসপাতালে নথিভ‚ক্ত করা হয়নি। তবে রোগীর স্বজনরা কান্নাকাটি করে বলছিলেন যে শিশুটি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে উদ্ধার করে তারা দ্রুত কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসেন। শিশুটির স্বজনদের বাড়ি শরীয়তপুরে।
অন্যদিকে, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর থেকে হাসপাতালটি আংশিকভাবে চালু করা হয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ সচিব জিএম সালেহ উদ্দিন বলেন, জরুরী বিভাগ চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তবে অগ্নিকান্ডের ঘটনাস্থলের আশেপাশের কয়েকটি ওয়ার্ডের চিকিৎসা সেবা বন্ধ থাকবে ঘটনা তদন্তের স্বার্থে।
এদিকে, কিভাবে আগুন লেগেছে সে বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ বলেন, হাসপাতালের নীচতলায় স্টোর রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে তারা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন। নীচতলার আনুমানিক ১৫ টি কক্ষ পুড়ে গেছে। ওইসব কক্ষে হাসপাতালের ওষুধ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতিসহ দাহ্য পদার্থ ছিল। এ কারণে আগুন নীচতলা থেকে সূত্রপাত হয়ে তা তিন তলায় শিশু ওয়ার্ডে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, বিকাল ৫টা ৫৫ মিনিটের সময় হাসপাতালের নতুন ভবন থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখে রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের সূত্রপাত ঘটার পরপরেই হাসপাতালটির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। সোয়া ৭টার দিকে বিদ্যুৎ ফিরে আসে। তখন হাসপাতালের সকল রোগীদের হাসপাতাল প্রাঙ্গনের মাঠে নামিয়ে আনা হয়। সেখানেই তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। পরবর্তীতে কয়েকশ অ্যাম্বুলেন্স করে রোগীদের বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অনেক রোগীকে স্বজনরা বাসায় নিয়ে গেছেন।
তৃতীয় তলায় স্টোর রুম থেকে আগুন লাগার পর ধোঁয়া চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় ছড়িয়ে পড়ে। এই দুই ফ্লোরে শিশু ও গাইনি ওয়ার্ড। সেখানে ব্লাড ব্যাংকও আছে। সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছিল অপারেশনের রোগীরা। ব্যান্ডেজ-স্যালাইন লাগানো অবস্থায়ই রোগীরা ছোটাছুটি শুরু করেন। কান্না-আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে হাসপাতালের পরিবেশ।
রোগীর স্বজনদের আহাজারি চারদিকে হঠাৎ চিৎকার চেচামেচি আগুন আগুন বলে। বাইরে এসে দেখি ধোয়া, উপরে আগুন। দিক বিকবিদিক কিছু ভাবার সময় পাইনি। রোগী নিয়ে বেরিয়ে এসেছি। এভাবেই সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আগুন লাগার পর আতঙ্কে বেরিয়ে আসার কথা বলেন, আট নং ওয়ার্ডে উর্মি নামের বরিশাল থেকে আসা রোগীর বাবা বাবুল ফকির।
তিনি বলেন, সন্ধ্যার সময়ও ছিলাম মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালের বেডে এখন খোলা আকাশশের নিচে। গত রবিবার ভর্তি ভর্তি করা হয় মেয়েকে। শনিবার মেয়ে উর্মির গলার অপারেশন হবার কথা ছিল। কিন্তু এখন সেসব ভাবনার সুযোগ নাই। আগুনের ভয়ে বেড়িয়েছি, অন্যকোনো হাসপাতালে যাবো, এখানে আর নয়।
১নং ওয়ার্ড ৮৫নং সিটের রোগী ঢাকা উদ্যান এলাকার আব্দুল গণি খাঁ। স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, এখানে স্বামীকে বাঁচার জন্যই ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু উল্টো মরার দশা। প্রথমে নার্সরা বলছিল আগুন নিভে যাবে। কিন্তু শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি স্বামীর আগুনের ধোয়ায় আরও খারাপ অবস্থা। তাই আর ঝুুকি নেই নি। বেরিয়ে এসেছি।
ব্রেন স্টোক করার পর আব্দুল খালেককে নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন ছেলে জহুরুল ইসলাম। ৭ ফেব্রুয়ারি ভর্তি করান সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। ১ নং ওয়ার্ড ১৫ নং বেডে জায়গাও হয়। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে দিকে আগুনের ধোঁয়া দেখে আতংক নিয়ে বেরিয়ে আসেন হাসপাতাল থেকে।
নাতি রানা কান্না করে বলছিলেন, একটা অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করছি, কিন্তু অক্সিজেন নেই। আর বুঝি দাদাকে বাঁচাতে পারবো না। শেষ চেষ্টায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যাচ্ছি। বাকিটা আল্লাহ ভরসা। এমন কথা বলতে বলতে একটা বেসরকারি এ্যাম্বুলেন্সে দাদাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যান। এরকম হাসপাতাল থেকে সরকারি বেসরকারি শতাধিক এ্যাম্বুলেন্স দিয়ে রোগীদের স্থানান্তর করা হয়। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করেন সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী। অ্যাম্বুলেন্সগুলো বিনা খরচে রোগীদের স্থানান্তর করেছে। আগুন নেভানোর কাজে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তারা প্রথমেই আইসিইউর রোগীদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আশপাশের পথচারীরাও ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করেন আগুন নেভাতে। তারা সবাই মিলে রোগীদের নিরাপদে বের হতে সহযোগিতা করেন। অনেকে কাঁধে করে রোগীদের হাসপাতাল থেকে বের করে আসেন।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, হাসপাতালে প্রায় বারশ’র মতো রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। এরমধ্যে আইসিইউতে ছিল ১০ জন। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রথমে শিশু ওয়ার্ডে রোগীদের সরিয়ে নিই। পরে আইসিইউ’র ১০ রোগীকে সরিয়ে আশেপাশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপরই আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও মুগদা জেনারেল হাসপাতালে যোগাযোগ করি। ওইসব হাসপাতালে প্রায় দেড়শ’ এ্যাম্বুলেন্স দিয়ে রোগী স্থানান্তর করা হয়।
রাত সাড়ে ৯ টায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য সচিব, হাসপাতালের পরিচালকসহ ঊর্দ্ধতনরা করণীয় ঠিক করতে জরুরি বৈঠকে বসেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা মেডিক্যালে প্রায় ৫শ’ রোগীকে স্থানান্তর করা হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে সকল চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে আসতে নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের সকল চিকিৎসক ও নার্সদের কাজে যোগ দিতে বলা হয়েছে।
আগুন নেভাতে এসে শুরুতেই পানি পাচ্ছিল না ফায়ার ইউনিট। পরে কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পুকুর থেকে পানি তুলে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করা হয়। এদিকে ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্মন বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের দ্রুত নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আগুনের চেয়ে ধোঁয়ার পরিমাণ বেশি ছিল। আর ধোঁয়ার কারণেই হাসপাতালে এলাকায় রোগী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। তবে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কি কারণে আগুন প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি, তদন্ত করার পরই এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যাবে।
রাত পৌনে ৮টার দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় চিকিৎসাধীন রোগীদের সকলেই নিরাপদে আছেন, দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। রোগীদের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, রোগীদের মধ্যে যারা একটু বেশি অসুস্থ তাদেরকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা হচ্ছে। রোগীরা নিরাপদে আছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান রাত সোয়া আটটার দিকে জানান, আগুন নেভাতে এসে প্রথমে পানি সঙ্কটে পড়েছিলেন তারা, তবে পরে তা কেটে যায়। স্টোর রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলে, পরে ধোঁয়া উপরে উঠে যায়।
আগুনের কারণে হাসপাতালের সামনের সড়কে দীর্ঘ যানজট লেগে যায়। রাত সাড়ে ৮টার পর যান চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল ছুটে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, আগুনে কারো হতাহতের খবর আমরা পাইনি। যত রোগী ছিল, তাদের সবাইকে বের করে আনা হয়েছে। রোগী ও স্বজনদের শান্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। রাত ৯ টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ঘটনাস্থলে যান। তিনিও সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেন।
রাত ১১ টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের সম্মেলন কক্ষে প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়। প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ সচিব জিএম সালেহ উদ্দিন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ, শহীদ সোহওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. এ বিএম মাকসুদুল আলম। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনাস্থলে শিশু ওয়ার্ডে ৭০ জন রোগী ভর্তি ছিল। তাদেরকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। যেসব হাসপাতালে রোগীদের স্থানান্তর করা হয়েছে, তারা চাইলে এই হাসপাতালে আবারও চিকিৎসা নিতে পারবেন। রাত থেকেই হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে এটি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। এ ঘটনা তদন্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করে রিপোর্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে।
Leave a Reply