বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পাঠাও এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহকে হত্যার পর নিজের বাসা ছেড়ে ৫ দিনের জন্য এয়ারবিএনবি’র একটি দামী এপার্টমেন্ট ভাড়া করেছিলেন টাইরেস ডেভোন হ্যাসপিল। এর অবস্থান নিহত ফাহিমের এপার্টমেন্ট থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে। খুনি টাইরেস গত বুধবার বিকেল থেকে সেখানেই অবস্থান করছিলেন এক বান্ধবীসহ। এমনকি বৃহস্পতিবার রাতে অস্থায়ী এই এপার্টমেন্টে বান্ধবীর জন্মদিনও উদযাপন করেন। এজন্য এপার্টমেন্টটি রঙিন বেলুন দিয়ে সাজানো হয়। ডাউনটাউন ম্যানহাটনের ১৭২ ক্রসবি স্ট্রিটে অবস্থিত এই এপার্টমেন্ট ভবনের লবি থেকেই শুক্রবার সকাল পৌনে ৯টায় তাকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি যৌথদল। নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের (এনওয়াইপিডি) গোয়েন্দারা ছাড়াও এই দলে ছিলেন নিউ ইয়র্ক ও নিউজার্সির রিজিওনাল ফিউগেটিভ টাস্কফোর্সের সদস্যরা।

এদিকে এনওয়াইপিডি’র গোয়েন্দা প্রধান রোডনি হ্যারিসন শুক্রবার বিকেলে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানান, প্রযুক্তি-উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ’র নৃশংস খুনের অভিযোগে তারই এক সময়ের বিশ্বস্ত সহচর টাইরেস ডি হ্যাসপিলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের অভিযোগ আনা হয়েছে।
বিচার প্রক্রিয়া শুরুর উদ্দেশ্যে শুক্রবার মধ্যরাতে তাকে আদালতে তোলা হয়। ভার্চুয়াল আদালতে অনুষ্ঠিত হয় শুনানি। ম্যানহাটনের আসিস্ট্যান্ট ডিসট্রিক্ট এটর্নি লিন্ডা ফোর্ড আদালতে বলেন, হ্যাসপিলের কেনা ইলেকট্রিক করাত ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, ভিডিওতে চিহ্নিত খুনির পোশাক মিলেছে হ্যাসপিলের বাড়িতে। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগে-পরের ভিডিও সার্ভিলেন্স থেকে অন্তত দু’জন হ্যাসপিলকে শনাক্ত করেছেন। শুনানি শেষে আদালত হ্যাসপিলকে আটক রাখার নির্দেশ দেন। ১৭ই আগস্ট তাকে আবার আদালতে হাজির করতে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের চার্জ হলো, ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ।

এনওয়াইপিডি’র একজন অফিসার মানবজমিনকে জানিয়েছেন, মূলত হ্যাসপিলের ব্যবহার করা উবার-লিমুজিনের সূত্র ধরেই তাকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। ভিডিও সার্ভেইলেন্সের মাধ্যমে হ্যাসপিলের ব্যবহার করা উবারের চালককে বৃহস্পতিবার খুঁজে বের করে পুলিশ। তার মাধ্যমেই বেরিয়ে আসে উবারের ভাড়া পরিশোধে ব্যবহৃত ক্রেডিট কার্ডের তথ্য। ফাহিম সালেহ’র ভেনচার ক্যাপিটাল কোম্পানি ‘অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল’-এর নামে ইস্যুকৃত ক্রেডিট কার্ড দিয়েই উবারের ভাড়া পরিশোধ করে হ্যাসপিল। ম্যানহাটনের ২৩ স্ট্রিট ও সিক্সথ এভিনিউতে অবস্থিত নির্মাণ সামগ্রীর চেইন স্টোর হোম ডিপোতে যাওয়া এবং আসার কাজে সে উবার ব্যবহার করে। হোম ডিপো থেকে সে ইলেক্ট্রিক করাত, গার্বেজ ব্যাগ এবং রক্তের দাগ পরিষ্কার করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ক্রয় করে। অবশ্য এগুলোর মূল্য সে কিভাবে পরিশোধ করেছে সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ভিডিও সার্ভেইলেন্সে তার হোম ডিপোতে প্রবেশ এবং বের হবার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া ক্রসবি স্ট্রিটে নেয়া এয়ারবিএনবি এপার্টমেন্টের ভাড়া পরিশোধে সে নিজের ক্রেডিটকার্ড ব্যবহার করেছে। তবে বৃহস্পতিবার রাতে বান্ধবীর জন্মদিন উদযাপনের জন্য যে বেলুন ও সাজ-সজ্জা সামগ্রী কেনা হয়েছিল সেগুলোর মূল্য পরিশোধ করা হয় অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটালের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে।

এর আগে গত মাসে হ্যাসপিল তার ব্যক্তিগত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে একটি ট্যাজার বা ইলেক্ট্রিক্যাল স্টান গান ক্রয় করে। এরপর নিজের ব্রুকলিনের বাসায় সেটি ডেলিভারি নেবার সময় ডেলিভারি স্লিপে স্বাক্ষরও করে। ফাহিমকে হত্যার আগে এই ট্যাজার বা ইলেক্ট্রিক্যাল স্টান গান দিয়েই তার ওপর প্রথম আক্রমণ চালায় হ্যাসপিল। তাতে ফাহিম জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় তাকে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর সেখান থেকে চলে যায় হ্যাসপিল। পরদিন মঙ্গলবার সে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে আবার আসে। এদিন সে ইলেক্ট্রিক করাত দিয়ে কেটে ফাহিমের মৃতদেহের বিভিন্ন অংশ আলাদা করে ফেলে এবং সেগুলো পৃথক পৃথক গার্বেজ ব্যাগে রাখে। তার উদ্দেশ্য ছিল ভবনটির সপ্তম তলা থেকেই এসব গার্বেজ ব্যাগ ময়লা ফেলবার জন্য নির্ধারিত সুড়ঙ্গে ফেলে দেয়া, যাতে ফাহিমের খুনের বিষয়টি কেউ জানতে না পারে। হত্যাকাণ্ডের অন্যান্য আলামত নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রও নিয়ে আসে। কিন্তু ফাহিমের খোঁজে তার খালাতো বোন মীরান চৌধুরী এপার্টমেন্ট ভবনটির নিচতলায় এসে কলিং বেলের সুইচে চাপ দেয়ার পর সবকিছু এলোমেলো রেখেই পালিয়ে যায় হ্যাসপিল। পালানোর সময় সে মূল দরজা দিয়ে বের না হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে সোজা সিড়িপথে নেমে যায়।

অন্যদিকে বেশ কয়েকবার কলিংবেল চেপেও ফাহিমের তরফ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ৯১১ নম্বরে কল দিয়ে পুলিশের সাহায্য চান মীরান। এরপর দ্রুততম সময়ে সেখানে হাজির হয় সেভেনথ প্রিসিঙ্কট এর একদল পুলিশ। তারা মীরানকে সঙ্গে নিয়েই সপ্তম তলায় যায় এবং এপার্টমেন্টের দরজা খুলে দিয়ে মীরনকে আগে ভেতরে প্রবেশ করতে বলে। তিনি ড্রয়িংরুমের ভেতরে উঁকি দিয়েই চিৎকার করে ওঠেন। কারণ সেখানে মস্তক ও হাত-পা বিহীন অবস্থায় পড়েছিল ফাহিমের দেহ। এরপর পুলিশ সদস্যরাও ভেতরে ঢুকে দেখতে পান সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। তাৎক্ষণিকভাবে তারা হত্যাকাণ্ডের সবরকম আলামত জব্দ করেন। পরবর্তীতে সেসব আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষার ভিত্তিতেই পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডে টাইরেস ডি হ্যাসপিলের সম্পৃক্ততা সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত হয়। এর মধ্যে ইলেক্ট্রিক্যাল স্টান গানের সঙ্গে থাকা কাগজ সদৃশ একটি বস্তুতে হ্যাসপিলের আঙ্গুলের পরিষ্কার ছাপ পাওয়া গেছে।

এনওয়াইপিডি সূত্র জানায়, নিউ ইয়র্ক সিটির বাইরে লং আইল্যান্ডের ভ্যালি স্ট্রিম এলাকায় বেড়ে ওঠা টাইরেস হ্যাসপিল বছর পাঁচেক আগে ফাহিম সালেহ’র সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কিছুকাল পরেই ব্রুকলিনের ৩১ উডরাফ এভিনিউর একটি ভাড়া করা এপার্টমেন্টে বসবাস শুরু করেন। তার ওই বাসাটি এখনো রয়েছে। এনওয়াইপিডি’র গোয়েন্দারা টাইরেসের খোঁজে বৃহস্পতিবার তার ব্রুকলিনের বাসায় হানা দেন। সেখানে তাকে না পেলেও পাওয়া যায় এক মহিলাকে। টাইরেসকে খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে গোয়েন্দারা ওই মহিলাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। যদিও পরক্ষণে ক্রেডিট কার্ডের সূত্র ধরে তার ম্যানহাটনে অবস্থানের ব্যাপারে নিশ্চিত হন তারা। শুক্রবার সকালে হ্যাসপিলকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পর সাংবাদিকরা কথা বলেন পাশের ভবনের তত্ত্বাবধায়ক বায়রন অ্যালেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় সে এতোটাই নির্লিপ্ত ছিল, কোনো শিশু দোকান থেকে ললিপপ চুরি করে ধরা পড়লে যেমনটি দেখায়।

টাইরেস ডেভোন হ্যাসপিল ২০১৬ সালে ভ্যালি স্ট্রিমের সেন্ট্রাল হাইস্কুল থেকে দ্বাদশ ক্লাসের গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে। পরের বছর ২০১৭ সালে সে লং আইল্যান্ডের হফস্ট্রা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। হাইস্কুলে পড়ার সময় সে ওয়েবসাইট ডিজাইনের ওপর একটি পুরষ্কারও লাভ করে। হ্যাসপিলের এক বন্ধু নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিককে জানিয়েছেন যে, হ্যাংআউটের জন্য মাঝে-মধ্যে আমরা তাকে গাড়িতে তুলে নিতাম। সে একটি ফস্টার হাউজে (সরকারি খরচে অন্যের বাড়িতে থাকা) থাকতো।

এনওয়াইপিডি’র একজন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ফাহিম সালেহ’র সঙ্গে হ্যাসপিলের সম্পর্কের সূচনা ২০১৬ সালে। এরপর সে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেও পড়াশোনায় অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ফাহিমের অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিতে তাকে ‘চিফ অব স্টাফ’ পদবী দেয়া হলেও বাস্তবে সে ফাহিমের সব কাজের সঙ্গেই যুক্ত ছিল। বিশেষত, ফাহিমের নিজস্ব আর্থিক বিষয়াদির পুরো দায়িত্ব ছিল তার ওপর। তাদের পারস্পারিক সম্পর্ক ‘এমপ্লয়ার-এমপ্লয়ী’র চেয়েও বেশি কিছু ছিল। এমনকি ফাহিমের বন্ধু মহলে এবং পারিবারিক পরিসরেও পরিচিত ছিল হ্যাসপিল।