রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফাহিম সালেহর ছিন্নমস্তক মৃতদেহ উদ্ধার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ। বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে ফাহিমের দেহ কয়েক টুকরো করা হয়েছে বলে জানায় নিউইয়র্কের পুলিশ।
মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে ৩টায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটনে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে ফাহিমের টুকরো টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়। ফাহিম সালেহ ‘পাঠাও’-এর মতো একই ভাবনায় প্রতিষ্ঠিত নাইজেরিয়ায় রাইড শেয়ারিং প্লাটফর্ম ‘গোকাডা’র প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ছিলেন। বাংলাদেশের সন্দ্বীপের হরিশপুরের সন্তান নিউইয়র্ক সিটি-সংলগ্ন পোকিস্পিতে বসবাসরত আইবিএমের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সালেহ আহমেদের একমাত্র ছেলে ফাহিম সালেহ। ফাহিমকে নির্মমভাবে হত্যার সংবাদ গভীর বেদনার সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় মার্কিন মিডিয়ায় প্রচার ও প্রকাশিত হচ্ছে। কারণ পিছিয়ে থাকা অঞ্চল, অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যতের সন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রে এসে বসতি গড়া পরিবারগুলোর মধ্যে অত্যন্ত মেধাবী, উদ্যমী ও সফল তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে মার্কিন ধারায় বিশেষ একটি স্থান করে নিয়েছিলেন ফাহিম।
পুলিশ জানায়, ঘাতককে খুঁজে বের করতে ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশ আরও জানায়, সুপরিকল্পিতভাবে তাকে করাত দিয়ে টুকরো টুকরো করার পর দেহের খন্ডিত অংশগুলো একটি থলেতে ভরার চেষ্টা করেছিল হত্যাকারী অ্যাপার্টমেন্টের (কন্ডো) ভিতর।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, গত বছর সোয়া দুই মিলিয়ন ডলারে কন্ডোমিনিয়াম এপার্টমেন্ট কেনেন ফাহিম। করোনা মহামারীর পুরো সময় তিনি ছিলেন মা-বাবার সঙ্গে পোকিস্পিতে। কয়েকদিন আগে তিনি এসেছিলেন অভিজাত শ্রেণির বিলাসবহুল এই অ্যাপার্টমেন্টে। স্বল্পভাষী ফাহিমের মৃত্যুসংবাদে গোটা কমিউনিটি স্তম্ভিত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। মাত্র ৩৩ বছর বয়সী ফাহিমের সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় অর্ধ বিলিয়ন ডলার। তবু কোনো অহমিকা ছিল না তার। সাদামাটা জীবন যাপনে অভ্যস্ত ফাহিম এখনো বিয়ের পিঁড়িতেও বসেননি। তার এই হত্যাকান্ডে কে বা কারা জড়িত তা উদঘাটনের দাবি উঠেছে কমিউনিটি এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে।

ম্যানহাটনের লোয়ার ইস্ট সাইডে সাফোক স্ট্রিটের ইস্ট হিউস্টন স্ট্রিটের ওপর লাক্সারি এই অ্যাপার্টমেন্টের প্রবেশপথের ভিডিও ফুটেজের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউইয়র্ক পুলিশের মুখপাত্র সার্জেন্ট কার্লোস নিয়েভেস বলেন, ‘ফাহিমের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা, বুক, দুই হাত ও দুই পা পেয়েছি কক্ষের ভিতরই।’ তিনি জানান, ফাহিমের বোনের টেলিফোন পেয়ে ওই ভবনের সপ্তমতলায় ফাহিমের কন্ডোতে যান তারা। আগের দিন থেকেই ফাহিমের কোনো সন্ধান না পেয়ে তার ছোট বোন উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এসেছিলেন এই কন্ডোতে। ভিতরে ভাইয়ের ছিন্নমস্তক দেহাবশেষ দেখেই ফোন করেছিলেন ৯১১-তে। ভিডিও ফুটেজের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ জানায়, স্থানীয় সময় সোমবার বিকালে ফাহিম ইলেভেটর দিয়ে ওই ভবনে ঢুকেছেন। তার পেছনেই স্যুট পরা এক ব্যক্তি, যার মাথায় টুপি, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস ছিল। সঙ্গে ছিল একটি সুটকেস। পুলিশের ধারণা, ফাহিম তার কন্ডোতে প্রবেশের সময় আক্রান্ত হতে পারেন। এর পরই তাকে হয়তো নিস্তেজ করা হতে পারে। পুলিশ কর্মকর্তা কার্লোস নিয়েভেস উল্লেখ করেন, ঘাতক খুবই ধূর্ত প্রকৃতির। ফাহিমের খন্ডিত দেহ প্লাস্টিকের ব্যাগে পাওয়া গেছে। করাতে তেমন রক্ত দেখেননি পুলিশ কর্মকর্তারা। মেধাবী ছাত্র ফাহিম নিউইয়র্কে একটি হাইস্কুলে পড়া অবস্থায়ই ‘উইজ টিন’ নামক একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলেন। বেশ অর্থও আয় করতে সক্ষম হন তিনি। এরপর ম্যাসাচুসেটস স্টেটের বেন্টলি ইউনিভার্সিটি থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে কম্পিউটার ইনফরমেশন সিস্টেমে ব্যাচেলর করেন ফাহিম। উদ্ভাবনী মেধাসম্পন্ন ফাহিম আর পেছনে ফিরে না তাকিয়ে, কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির চেষ্টা না করেই মা-বাবার জন্মস্থান বাংলাদেশে ছোটেন। ২০১৫ সালে ঢাকায় মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনে ‘পাঠাও’ প্রযুক্তির প্রচলন ঘটান আরও দুই বন্ধুর সঙ্গে। ঢাকায় অবস্থানকালেই এর আগে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘হ্যাকহাউস’ নামক আরেকটি সংস্থা। রাজধানীর বনানীতে ছিল এর হেড অফিস। ‘পাঠাও’-এর প্রচলন রাজধানী ঢাকা ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন শহরে বিস্তৃত হয়। একপর্যায়ে তা নেপালেও সম্প্রসারিত হয়েছে। এমন অবস্থায় ঢাকা ছাড়েন ফাহিম। নাইজেরিয়ায় পরিচিত একজনের সঙ্গে পার্টনারশিপে মোটরবাইকে শেয়ারিং সার্ভিস হিসেবে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে লাগোসে চালু করেন ‘গোকাডা’। সেই ব্যবসা জমে উঠলেও নানা কারণে তা বছরখানেক পরই বন্ধ হয়ে গেছে বলে ফাহিমের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে একটি কোম্পানি স্থাপন করেছেন বলে ফাহিমের এক নিকটাত্মীয় জানান। বিনোদনমূলক অ্যাপারেটাস কোম্পানি ‘কিকব্যাক’-এরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফাহিম। প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার ছিলেন অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিট্যালের।