জাতীয় স্বদেশ | তারিখঃ জানুয়ারি ৭, ২০২০ | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 336 বার
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, ছায়ানটের নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ও বারডেমের বোর্ড অব ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান ডা. সারওয়ার আলীকে সপরিবারে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। গত রবিবার রাতে রাজধানীর উত্তরার নিজ বাসভবনে এ ঘটনার সময় সচেতন প্রতিবেশী এগিয়ে আসায় প্রাণে বেঁচে গেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের এই অন্যতম সংগঠক ও যোদ্ধা।
জানা গেছে, গত রবিবার রাতে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ১৪ নম্বর রোডের ৪ নম্বর বাড়ির চারতলার বাসায় স্ত্রী ডা. মাখদুমা নার্গিসকে সঙ্গে নিয়ে টিভি দেখছিলেন ডা. সারওয়ার আলী। রাত সাড়ে ১০টার দিকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে তিনি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে এক যুবক হাতে ছুরি নিয়ে ভেতরে ঢুকে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে দরোজার কাছেই মেঝেতে ফেলে দিয়ে বুকে চেপে বসে। ডা. সারওয়ার ধস্তাধস্তি শুরু করলে হামলাকারীর হাতে ধরা ছুরিটি ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে। এই পর্যায়ে সে ডা. সারওয়ারকে শ্বাসরোধে হত্যার চেষ্টা চালায়। ডা. মাখদুমা নার্গিস এ ঘটনা দেখে চিৎকার শুরু করেন। আর ঠিক তখনই আরেক যুবক ঢুকে পড়ে ওই ফ্ল্যাটে। মাখদুমা নার্গিস বাধা দিলে সে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
এদিকে ধস্তাধস্তি ও চিৎকারের শব্দ শুনে ভবনের দ্বিতীয় তলার বাসিন্দা বসুন্ধরা গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (এইচ আর অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড সিকিউরিটি) মেজর (অব.) শাহাব উদ্দিন চাকলাদার ওপরে উঠে আসেন। তিনি বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা দিতেই তা খুলে যায়। আর ভেতরে তাকাতেই দেখতে পান যে এক যুবক ডা. সারওয়ার আলীকে গলাটিপে হত্যার চেষ্টা করছে। প্রথমে তিনি বুঝতে না পেরে জানতে চান, ‘কী হয়েছে উনার?’ বুকে চেপে বসা যুবক উত্তর দেয়, ‘স্ট্রোক করেছে। এ কারণে বুকে বসে চাপ দিচ্ছি।’ তাহলে গলায় টিপছ কেন?—এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ওই যুবক ডা. সারওয়ার আলীর বুকের ওপর থেকে উঠে গিয়ে কিছুটা দূরে পড়ে থাকা ছুরি হাতে নিয়ে চাকলাদারের ওপর হামলা চালায়। হাত দিয়ে ফেরাতে গেলে ছুরির আঘাতে তাঁর হাত কেটে যায়। পরে তার পেটে ছুরি মারতে উদ্যত হয় ওই যুবক। আর ওই মুহূর্তেই চাকলাদারের ছেলে মোবাশ্বের ওই বাসায় আসেন। তিনি তাত্ক্ষণিক বিষয়টি আঁচ করতে পেরে একটি কাচের টেবিল তুলে ছুড়ে মারেন ওই যুবকের দিকে। এই পর্যায়ে মোবাশ্বেরের হাতে ছুরিকাঘাত করে হামলাকারী দৌড়ে বেরিয়ে যায়।
সরেজমিনে গতকাল সোমবার বিকেলে ওই বাড়িতে গেলে ডা. সারওয়ার আলী পুরো ঘটনা কালের কণ্ঠকে জানান। তিনি জানান, রাত ১০টা ২৫ মিনিটের দিকে তৃতীয় তলায় তার মেয়ের বাসায় দুই যুবক প্রবেশ করে। এ সময় তাঁর মেয়ে ড. সায়মা আলী (রেনেটা লিমিটেডের ডিরেক্টর) ও তাঁর স্বামী হুমায়ূন কবীর (একমির ডিরেক্টর) ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া নাতনি অহনা কবিরকে নিয়ে ওদের ফ্ল্যাটেই ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক যুবক সেখান থেকে বেরিয়ে এসে চারতলায় ডা. সারওয়ার আলীর ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে। ওদিকে মেয়ের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করা আরেক যুবক বাসার তিনজনকে জিম্মি করে রাখে। একপর্যায়ে ওই যুবক চারতলার খোঁজ নিতে দরোজার বাইরে উঁকি দিলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ওরা দরোজা বন্ধ করে দেন। একই সঙ্গে ৯৯৯ নম্বরে পুলিশকে ফোন করে বারান্দায় বেরিয়ে ‘ডাকাত ডাকাত’ বলে চিৎকার করতে থাকেন।
মেজর (অব.) শাহাব উদ্দিন চাকলাদার বলেন, ‘আমরা বাসায় ছিলাম। হঠাৎ ওপরের দিকে জোরালো শব্দ শুনে আমার স্ত্রী ওপরে গিয়ে বিষয়টি দেখতে বলেন। আমি চারতলায় গিয়ে দেখি ভেতর থেকে শব্দ হচ্ছে। বিষয়টি স্বাভাবিক মনে না হওয়ায় দরোজায় ধাক্কা দেই। দরোজা খুলে গেলে ভেতরে তাকিয়ে দেখতে পাই যে এক ব্যক্তি বাড়ির মালিককে ফ্লোরে ফেলে হত্যার চেষ্টা করছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে অবসরপ্রাপ্ত এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি মনে করি একটি বাড়িতে যাঁরা থাকেন তাঁদের কারো বিপদ হলে সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের এগিয়ে আসা উচিত। আমি ও আমার ছেলে এগিয়ে না গেলে কী হতো আল্লাহই ভালো জানেন।’
সূত্র জানায়, ডা. সারওয়ার আলীর গাড়িচালক নাজমুল কয়েক মাস আগে গাড়ি চালানোর সময় ভুল করায় মাখদুমা নার্গিস তাকে ধমক দেন। সেদিনই সে হুমকি দিয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যায়। ওই গাড়িচালক মাঝেমধ্যেই বাড়ির দারোয়ান হাসানের সঙ্গে এসে গল্প করত।
ঘটনাস্থল বাড়ির নিচতলায় তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ একটি স্কুল ব্যাগের ভেতর থেকে সাতটি নতুন চাপাতি, লম্বা দড়ি, ক্যামেরা স্ট্যান্ড ও স্কচটেপ উদ্ধার করেছে। একটি মোবাইল ফোন সেটও পাওয়া গেছে। সেটি সাবেক গাড়িচালক নাজমুলের বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। তাকে আটকের চেষ্টা করা হচ্ছে।
উত্তরা-পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা জানান, ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেয়ে পুলিশের টহল টিম দ্রুত ওই বাড়িতে হাজির হয়। ততক্ষণে ওই যুবকরা পালিয়ে যায়। বাড়ির দারোয়ান হাসান (৫২) ও মান্নান নামের এক গাড়িচালককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে হত্যার জন্যই পালিয়ে যাওয়া যুবকরা বাড়িতে ঢুকেছিল। পুরো বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এ ঘটনায় আরো একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাত বছর আগে থেকে ওই বাড়িতে দারোয়ানের চাকরি করেন হাসান। তাঁর বাড়ি বরিশালে। সে-ই খুনিদের ঢুকতে দেওয়া থেকে শুরু করে বের করে দেওয়া পর্যন্ত সহযোগিতা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হাসান জানিয়েছেন, চাকরি ছেড়ে যাওয়া গাড়িচালক নাজমুলই চাপাতিসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ওখানে রেখে গেছে। আর আটককৃত চালক মান্নানই নাজমুলকে গাড়িচালক হিসেবে চাকরির সুপারিশ করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, ডা. সারওয়ার আলী একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেন। শেষের দিকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রেও ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর তাঁর স্ত্রী ডা. মাখদুমা নার্গিস স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সচিব পদমর্যাদায় অবসরে গেছেন। তিনি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের পরিচালক পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন।উৎস -কালের কন্ঠ
Leave a Reply